বাস্তববাদী বিদ্রোহী কবি নজরুল

বাস্তববাদী বিদ্রোহী কবি নজরুল

মোহীত উল আলম: কবি নজরুলের ওপর ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত এবং ১৯৯৯ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত হায়াৎ মামুদ ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সম্পাদিত ক্লাসিক গ্রন্থ ‘তোমার সাম্রাজ্যে যুবরাজ’-এর প্রথম রচনা ‘যুবরাজ, তাঁর চলাচল’ শীর্ষক প্রবন্ধে হায়াৎ মামুদ প্রায় নির্দ্বিধায় কবি নজরুলকে রোমান্টিক বিদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলছেন: ‘আসলে নজরুল রোমান্টিক। তাঁর প্রকৃত চরিত্র এই রোমান্টিকতা, আর আমরা যাকে তাঁর বিদ্রোহ নামে শনাক্ত করি, তা-ও ঐ রোমান্টিকতারই এক তুঙ্গ প্রকাশ। তাঁর বিদ্রোহ অগত্যা, রোমান্টিক বিদ্রোহ।’ (পৃ. ১০)
হায়াৎ মামুদের অনুযোগ ছিল নজরুল সাম্যবাদী চেতনার কবি হলেও মার্ক্সবাদে দীক্ষিত ছিলেন না। হায়াৎ মামুদের এই মতামতটি আমরা অনেকেই সমর্থন করি এবং জানি যে এটি তাঁর পূর্বসূরি আহমদ শরীফ নজরুলের ওপর তাঁর একাধিক রচনায় প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন যে কবি নজরুল ছিলেন অ-তাত্ত্বিক কবি: ‘তাই তাঁর কাব্যে দর্শন নেই, তত্ত্ব নেই।’ (‘নজরুল মানস’, বিচিত চিন্তা, পৃ. ৩৬৮)
আহমদ শরীফ নজরুলকে ‘যুগন্ধর কবি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলছেন-নজরুল সময়ের প্রয়োজনে প্রাণাবেগে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, কিন্তু এর তলায় কোনো সুনির্দিষ্ট দর্শন ক্রিয়াশীল ছিল না: “এ জন্যই তাঁর কাব্যে দর্শন নেই, সমাজত্ত¡ নেই, নতুন সমাজ গড়ার সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। কেবল যা চেয়েছেন, তা পাননি বলে প্রবল উত্তেজনায় সম্মুখে যাকে পেয়েছেন তাকেই আক্রমণ করেছেন, কার্যকে ভেবেছেন কারণ, আর ‘কারণ’-এর খোঁজ পাননি বড় একটা।” (‘নজরুল মানস’, বিচিত চিন্তা, পৃ. ৩৬৮)
উপরোক্ত দুজন বিশিষ্ট চিন্তকের অনুযোগের বিপক্ষে আমি যে কথাটা দাঁড় করাতে চাইছি, সেটা হলো নজরুল রোমান্টিক অর্থে বিদ্রোহী ছিলেন না, ছিলেন বাস্তব অর্থেই বিদ্রোহী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নজরুলের কাব্যিক উচ্চারণ দারিদ্র্য, শোষণ, স্বৈরশাসন, উঞ্ছবৃত্তি, সাম্প্রদায়িকতা ও অমানবতার বিরুদ্ধে অকুতোভয় সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছে এবং বাংলাদেশে যত দিন উপরোক্ত সমস্যাগুলো রয়েছে, তত দিন এগুলোর বিরুদ্ধে নজরুলের ভূমিকা অবশ্যই একজন বাস্তববাদী বিদ্রোহীর, রোমান্টিক বিদ্রোহীর নয়।
সাম্যবাদী তত্ত্বের একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ব্যক্তিমানুষের উদ্বোধনী শক্তি বা সৃজনশীল ক্ষমতার বা তাঁর ভেতরের নেতৃত্বের গুণাবলিকে সাম্যতার নামে খাটো করে দেখা। ব্যাপারটা হচ্ছে, জীববিজ্ঞানের শর্তানুযায়ী পৃথিবীর সব মানুষ এক ও অভিন্ন জাতি হলেও মানুষে মানুষে তফাতটা আসে তার ব্যক্তিগত কিছু বিশিষ্ট গুণাবলির জন্য।
কলম্বাসকে রানি ইসাবেলা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কিভাবে জানেন যে পশ্চিম দিকে সমুদ্রযাত্রা করলেই আপনি ভারতে পৌঁছবেন। কলম্বাস উত্তর দিয়েছিলেন, আমি তা জানি না, কিন্তু আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে পশ্চিম দিকে সমুদ্রযাত্রা করলেই আমি স্থলভাগ দেখতে পাব। এটাই ব্যক্তিমানুষ, যিনি সমাজকে নেতৃত্ব দেন, হন পথপ্রদর্শক।
বস্তুত কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে শুধু শ্রেণিবিহীন হয়ে কিংবা প্রলেতারিয়েত দিয়ে শাসিত হয়ে রাষ্ট্রীয় সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। কবি নজরুল মার্ক্সবাদে দীক্ষিত না হয়েও এই তত্ত্বটার অসারতা সম্যক অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং সেজন্যই তিনি সমাজের শ্রেণিবিভক্তির কথা স্বীকার করেই বিদ্যমান অনাচারগুলোর বিরুদ্ধে কলমের সৈনিক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন।
বাংলাদেশ যেহেতু শ্রেণিবিভক্ত সমাজ এবং এখানে যেহেতু সর্বক্ষেত্রেই প্রচুর অনাচার রয়েছে, সেজন্য নজরুলের বাক্যাবলি সর্বাংশেই একজন প্রকৃত বিদ্রোহী কবির উচ্চারণ বলেই স্বীকৃতি পাবে। যখন শ্রেণিবিভক্তির কথা স্বীকার করে আমরা বিদ্রোহের প্রসঙ্গ আনি, তখন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলে থাকেন যে কবি নজরুল বিদ্রোহীর নয়, সংস্কারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই কথাটাও আমি মানছি না। কারণ সংস্কারকের ভূমিকা বড় অর্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বন্ধকরণ ও বিধবা বিবাহ প্রচলন করে সাধন করেছিলেন কিংবা ছোট অর্থে একজন দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রী বয়স্ক ভাতা প্রচলন ইত্যাদির মাধ্যমে সাধন করতে পারেন, কিন্তু কবি নজরুল সেই অর্থে সংস্কারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন চেতনা জাগ্রত করার অর্থে বিদ্রোহী। সংস্কারকের কাজ একটা সময়ের পরে শেষ হয়ে যায়, সেটা ইতিহাসের অংশ হয় কেবল, কিন্তু এটার প্রবহমান আবশ্যকীয়তা থাকে না বিধায় এটাকে উল্লেখ করে স্মরণ করতে হয়, যেমন এখন আমি সতীদাহ প্রথা বন্ধকরণ ও বিধবা বিবাহ প্রচলনের কথা উল্লেখ করলাম। কিন্তু বিদ্রোহের চেতনাটা যুগন্ধর নয়, যুগোত্তর-যেমন নজরুলের বিদ্রোহীচেতনা লব্ধ কবিতা ও গান এখনো আমাদের জাগিয়ে তুলছে নতুন প্রাণের ইশারায়।

কয়েকটা উদাহরণ দিই : ‘মানুষ’ কবিতায় কবি নজরুল ‘গায়ে আজারির চিন’ অর্থাৎ শরীরে দারিদ্র্যের চিহ্নের কথা বলেছেন। একটা রাজনৈতিক সমাজে মানুষ কেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত পাতবে? গাড়ির কাঁচের জানালায় মৃদু চপেটাঘাত করবে ভিক্ষার জন্য? কেন? নজরুলের প্রশ্ন, আমাদেরও প্রশ্ন। ‘গায়ে আজারির চিন’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে নজরুলের দিব্যদৃষ্টির পরিচায়ক। কারণ এই অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ যে একটা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধন করেছে, সেটা হচ্ছে বস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবং এখানে মার্ক্সীয় সূত্র পুরোপুরিভাবে ক্রিয়াশীল। বস্ত্র উৎপাদন শিল্পের মাধ্যমে বিরাট একটা মালিক শ্রেণি বা পুঁজিপতি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে এবং এই নব্য পুঁজিপতি গোষ্ঠী দেশের টাকা দেশে না রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে এরই মধ্যে পাচার করে দিয়েছে। নজরুল দেখাচ্ছেন যে বস্ত্র নামক উপযোগ তৈরি করার মাধ্যমে একটা শ্রেণি বরাবর স্ফীত হয়েছে আর সৃষ্টি হয়েছে শোষিতের বিশাল বংশ, যাদের বস্ত্র জীর্ণ, যাদের পেট খালি। এটা কি খোদ বিদ্রোহ নয়? এটা কি কেবল রোমান্টিক উচ্চারণ? রাজনৈতিক অঙ্গনে এর কি প্রত্যক্ষ প্রতিফলন হয় না?
আবার বস্ত্রকর্মীদের বেশিরভাগই নারী শ্রমিক এবং নারীরা চিরতরে পুরুষশাসিত সমাজে শোষণের শিকার। ‘বারাঙ্গনা’ ও ‘নারী’ শীর্ষক কবিতাদ্বয়ে লৈঙ্গিক রাজনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা বললেন। ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় ‘তবুও গর্ব কত’ বলে প্রকাশ করলেন পুরুষ জাতির প্রতি শ্লেষ। পুরুষ পুরুষতান্ত্রিকতার নামে যৌনতাকে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিকভাবে নারীর ওপর ব্যবহার করে তাকে করেছে বশ্য এবং এই বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নারীকে শুধু যৌনতার ক্ষেত্রে নয়, সাংসারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও করেছে বশ্যতার শিকার। সংসারের লক্ষী বলে নারীকে অভিহিত করে প্রকারান্তরে তার বহির্জীবনের রাজনৈতিক অধিকার করেছে হরণ।
তাঁর উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ কিংবা ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর নির্যাস এই যে মানুষের শরীরই শেষ পর্যন্ত সামাজিক বঞ্চনার শিকার হয়। মানুষ শোষিত হতে হতে ন্যাংটা হয়ে গেলে পেটের ক্ষুধা মেটানোটাই তার পরম লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস থেকে সমাজকর্মী আনসারের বক্তব্য তুলে ধরা যায়, যেটা মানুষের নেতিবাচক সংজ্ঞার একটা স্পষ্ট ম্যানিফেস্টো। আনসার লতিফা অর্থাৎ বুঁচিকে বলছে : ‘সত্যিই রে বুঁচি, ক্ষুধিত মানুষ-অভাব-পীড়িত মানুষের মতো সকল-দিক দিয়ে অধঃপতিত আর কেউ নয়!’
‘আমার পথ’ শীর্ষক নিবন্ধে বলছেন: ‘আমার কর্ণধার আমি। আমায় পথ দেখাবে আমার সত্য।… যে-পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ ছাড়া আর কোনো পথই আমার বিপথ নয়। রাজভয়-লোকভয় কোনো ভয়ই আমার কিছু করতে পারবে না।’
বাংলাদেশের মানুষ নজরুলের ‘আমার পথ’ বলতে বিদ্রোহের মাধ্যমে বলবে : ‘নিজকে চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে, সে আপন সত্য ছাড়া আর কারুকখে কুর্নিশ করে না-অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারে না।’ নজরুলের বিদ্রোহী চেতনায় আমরা যারপরনাই পুষ্টিত।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *