স্মরণ করছি তাঁর সৃষ্টি দিয়ে

স্মরণ করছি তাঁর সৃষ্টি দিয়ে

গোলাম কবির: রবীন্দ্রনাথ ১৩১৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের ২০ তারিখে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ১৪২ সংখ্যক গীতটি রচনা করেছিলেন। গ্রন্থস্থিত হওয়ার সময় এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪২। তবে পত্রিকায় প্রথম মুখ দেখা দেয় ‘যাবার দিন’ নামে। ‘সঞ্চয়িতা’য় নামটি অক্ষুণ্ন থাকলেও স্বতন্ত্র ‘গীতাঞ্জলি’ কিংবা ‘রচনাবলি’তে সংখ্যাটি প্রাধান্য পায়।
আমরা ব্যবচ্ছেদের গভীরে যাব না। দেখব মর্ত্যের চারণাঙ্গন ত্যাগের (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮) ৩১ বছর আগে। পদ্মার শ্যামল ধারার রসে রঞ্জিত হয়ে কী অপরূপ অনুভূতি তিনি রেখে গেলেন আমাদের নিজেদের দেখার বিপুল বৈভব রূপে। এ গানেই তিনি বলেছিলেন: ‘বিশ্বরূপের খেলা ঘরে/কতই গেলেম খেলে/অপরূপকে দেখে গেলেম/দুটি নয়ন মেলে। (১৪২)
মানুষ সাধারণত যৌবনবেলায় জীবনের ভোগ মাধুরীকে প্রাণ উজাড় করে স্মরণ করে। ভবিষ্যতে কী করবে, কতখানি সুন্দর হবে প্রকৃতির সুধা-সেই সঙ্গে ব্যক্তিজীবন, তা নিয়ে কোনো ভাবিত হয় না। রবীন্দ্র-প্রতিভা এমনই অভাবনীয় সুধা দান করে গেছে, যা আজও ম্লান হয়নি। সূচনায় বলা হয়েছে, ১৪২ সংখ্যক ‘যাবার দিন’ গানটি রচনার সময় কবির অবস্থান ছিল পূর্ব বাংলার শিলাইদহে।
এই ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ১৩০ সংখ্যক গানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন: ‘মরে গিয়ে বাঁচবো আমি তবে,’ কবি লোকান্তরিত; তবে চিরজীবী হয়ে আছেন মানবজীবনের নানা অনুষঙ্গে। বিষয়টি আমরা সহসা অনুভব করি না। এ নিয়ে কত কলহ, ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রে। আমাদের এই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে রবীন্দ্র স্মরণোৎসবকে নিরুৎসাহ করা হয়েছে। পারেনি।
ইমরুল কায়েস-ওমর খৈয়াম একদা নিজ বাসভূমে প্রায় উপেক্ষিত হয়ে পড়েছিলেন। ভাষার মোড়ক ছেদ করে আমরা সেখানে চিরকালের জীবন-রস উপভোগ করি।
রবীন্দ্রনাথ ১৩০ সংখ্যক গানে ওই যে সবিনয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, আজ তা পূর্ণতার পথে। অবশ্য আমরা আজ পালন করি অনেকে প্রাণের টানে, অনেকে হুজুগে, কেউ কেউ আবার কাঁচা পয়সার অভিলাষে।
আমরা আমাদের জীবনকে অহরহ চোখের জল ফেলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি। তিনি বলেছিলেন: ‘প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল, একদিন নয় হাসিবি তোরা।’ হয়তো আমরা আনন্দধারায় অবগাহনের জন্য রবীন্দ্র সৃষ্টিধারায় শরণ কামনা করি। এ কামনা আমাদের হৃদিভার লাঘব করার সাধনা।
দারা-পুত্র-পরিবার, জনক-জননী চলে গেছেন, সব মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে। রবীন্দ্রনাথের তা নিয়ে অভিযোগ ছিল কোথায়! জামাতাদের উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যক্তিসুখ বিসর্জন দিয়েছেন, অথচ জীবনে সামান্যতম সম্মান তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। কবিতা কিংবা গল্পে তা আসেনি। তবে অসাধারণ পত্রাবলিতে যন্ত্রণা ঢাকতে পারেননি। এর সত্তেও তিনি ভেঙে পড়েননি। জীবনের ভার বহনে ‘দীর্ঘ জীবন দীর্ঘ অভিশাপ’ মনে করলেও তিনি বিশ্বাস করতেন: “আমি জানি, যাব যবে/সংসারে রঙ্গভূমি ছাড়ি,/সাক্ষ্য দেবে পুষ্পবন ঋতুতে ঋতুতে/এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি/এ ভালোবাসায় সত্য, এ জন্মের দান।/বিদায় নেবার কালে/এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার/ (২৮ নভেম্বর ১৯৪০, উদয়ন-প্রাতে)।
মরণসাগরের কূলে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর ভয়ের রূপের ছায়া তাঁকে ছলনা করেছে। তাঁর ধারণা, ‘যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস/ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।’ (শেষ লেখা, জোড়াসাঁকো, ২৯ জুলাই ১৯৪১) আমরা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সমীকরণে পা না ফেলে আমাদের জীবনের জন্য উপাদেয় বিষয়গুলো গ্রহণ-বর্জনের যে বিড়ম্বনাহীন জীবনের ছায়াপথ তিনি রেখে গেছেন, তা ফিরে দেখলে দোষের কী! অথচ এখানেই মতবাদীর কত আপত্তি।
ধর্ম কিংবা মতবাদের বিভক্তির শেষ নেই। মানবপ্রেমিক কবিরা বিভাজনের মধ্যে খুব বেশি চর্চিত হন না। প্রতিভাবান কবিদের মানুষ একই বলয়ে থেকে তাঁকে স্মরণ করে। আর এই স্মরণের মাল-মসলা রবীন্দ্রনাথ রেখে গেছেন, বর্ণনায় নয়-জীবনস্পর্শী রচনায়, যে রচনা পুরনো হয় না। মানুষের সুখ-দুঃখের অনুভূতি কখনো পুরনো হয়? সেই ‘কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা’র সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল সৃষ্টির ধারা। সেখানে অবগাহন করে আমরা পরিতৃপ্ত হই।
জীবন চর্চার বিধান তিনি দেননি। মানুষের ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিষয়গুলো তাঁর সৃষ্টির ধারার মাঝে কোলাকুলি করেছে। তাই দেখে আমরা মোহিত-চমৎকৃত হই। এখানেই রবীন্দ্র সৃষ্টির সার্থকতা।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *