প্রয়াণবার্ষিকীর শ্রদ্ধা

প্রয়াণবার্ষিকীর শ্রদ্ধা

নজরুলকে নিয়ে আমরা যেসব সমস্যায় পড়ি

আবুল ফজল: নজরুলের বয়স তখন ৩০। কলকাতার অ্যালবার্ট হলে আয়োজন করা হয় কবি-সংবর্ধনা সভা। বিরাট সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলার সব অঙ্গনের বড় বড় লোকেরা। নেতাজি সেদিন বলেন, ‘ভারতবর্ষ যেদিন স্বাধীন হবে, বাঙালির জাতীয় কবি হবেন কাজী নজরুল ইসলাম।’ কবির মনে তখন অস্বস্তি তৈরি হয়। দ্বিধাহীনভাবে তিনি বলেন, ‘এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে, আমি শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।’ তার কিছুদিন পর এক অভিভাষণে নিজের সময়কে তিনি বলেন-‘অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগ’। আর নিজেকে পরিচয় করান, সেই যুগের ‘অভিযান সেনাদলের তূর্য-বাদক’ হিসেবে। চোখের সামনে তিনি প্রত্যক্ষ করেন ‘হিন্দু-মুসলমানের হানাহানি’। ফলে ‘দুপক্ষকে ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাতে’ চান। যাপনের একান্ত পরিসরেও করেন সেটাই। বিয়ে করেন প্রমীলাকে। রচনার পরতে পরতে ছড়িয়ে দেন অসাম্প্রদায়িক মননের বীজ। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দেখে খেপে গিয়ে বলেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, এই জিজ্ঞাসে কোন জন?’ জাত-পাত প্রসঙ্গে বলেন, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া’। আর বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ককে চিহ্নিত করেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ বলে।
‘বাঙালির জাতীয় কবি’ শব্দবন্ধে অস্বস্তিতে ভোগা, ধর্ম-বর্ণ আর স্থান-কালের ভেদ-ভাবনাহীন বিরল সেই মানুষটি এখন রাষ্ট্রধর্ম থাকা একটা দেশের জাতীয় কবি। ফলে চক্ষুলজ্জার কারণে হলেও সেই দেশকে এবং দেশের লোকদের তাঁর জন্ম-মৃত্যুর দিন দুটি খুব ঘটা করে উদ্যাপন করতে হয়। বিচিত্র সব অনুষ্ঠান থেকে আসতে থাকে জোর আওয়াজ। এর সঙ্গে সঙ্গেই উপদেশ আসে, ‘তাঁকে চর্চা করতে হবে।’ দেশটার বয়স ইতিমধ্যে ৫০, অথচ ‘পরিপূর্ণভাবে তাঁর চর্চা করা হয়েছে’-এমন দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। ‘এখন চর্চা করছি’-এমনটা বলা সাহসও নেই কারও, না রাষ্ট্রের আর না কোনো ব্যক্তির। এ কারণে শুধু জমা হতে থাকে ভবিষ্য-প্রত্যয়ের আজগুবি সব কথামালা। জিনিসটা মন্দও নয়। চর্চা না হয়ে থাকলে সেই বোধোদয়টা ভালো। এখন করতে না পারলে তার স্বীকারোক্তিও প্রশংসনীয়। ভবিষ্যতে চর্চা করতে হবে, সেটাও আশারই কথা। কিন্তু চর্চা যে করা হবে, সেটা কোন নজরুলের? কোনো মহলের কোনো উপদেশ থেকেই সেটা স্পষ্ট হয় না।
উঁচু তলার লোকেরা তাঁকে বাদ দিতে পারলে বাঁচেন। নামটা শুনলেই তাঁদের অস্বস্তি হয়, বিব্রত লাগে। কীসব ভয়ংকর কথা বলেছে লোকটা! ‘গাহি সাম্যের গান’ কিংবা ‘আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।’ সংবিধানে না হয় থাকলই ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটা, ‘আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান’, সে কথা বলা হয়েছে হোক, তাই বলে কীভাবে এসব কথা সহ্য করা যায়?
মধ্যবিত্তরাও তাঁকে নিয়ে প্রবল অস্বস্তিতে থাকেন। লোকটাকে নিয়ে তাঁদের বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই। নজরুলের নাম নেওয়ার আগে প্রতিবারই তাঁরা রবীন্দ্রনাথের নামটা জোরেশোরে উচ্চারণ করেন-ভালোবেসে নয়, ঢাল হিসেবে। শ্রেণিগত চেতনার হীনম্মন্যতা ঢাকতে বিশ্বকবিকে তাঁরা ব্যবহার করেন। অথচ ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্র ছাড়া দুজনের তুলনার খুব প্রাসঙ্গিকতা নেই। তবু কাজটা করা হয়। রবিবাবু তো নোবেলে ভূষিত, জমিদারের সন্তান, সারা দুনিয়ায় তাঁর নামডাক। তাঁর তুলনায় নজরুল একেবারে নিচু জাত। চুরুলিয়া নামের অখ্যাত এক গ্রামের, দরিদ্র হাভাতে ঘরের সন্তান। খেয়ালের হাওয়া আর অনিশ্চয়ের তাড়নায় দিগ্ভ্রষ্ট। শৈশব থেকেই কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়ানো এবং অন্যের অনুগ্রহে লালিত-পালিত। তাঁর জীবনের কোনো উন্নত বিন্যাস নেই, যাপনও প্রভূতভাবে বিতর্কিত। জীবনে তিনি করেননি কী? বাউণ্ডুলে, বেপরোয়া জীবনযাপন করেছেন। লেখাপত্রেও গোরা সাহেবদের ‘রেফারেন্স’ নেই। সব মিলিয়ে একেবারে ‘মফস্সলি ব্যাপার-স্যাপার’। কিন্তু সেটা তাঁদের আসল সমস্যা নয়। নজরুলের বাউন্ডুলে জীবনটা কোনো ব্যাপারই নয়। শরৎ-সুনীল-শক্তিরাও তো বাউন্ডুলে, তাঁদের গ্রাহ্য করতে তো কোনো অসুবিধা হয় না। নজরুলকে নিয়ে তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
নজরুলকে নিয়ে তাঁদের আসল অসুবিধা উপনিবেশিত মনে। ইউরোপীয় প্রভুদের উচ্ছিষ্ট জ্ঞানের স্তাবকেরা চান এমন এক বাউন্ডুলে কবি, মাতলামি করতে করতেও যিনি পাশ্চাত্য পদ্য বলতে পারেন আর যেকোনো কথাকেই বানাতে পারেন ‘অস্পষ্ট ভাবাদর্শ’ কিংবা প্রেম ও রোমাঞ্চের উপভোগ্য ককটেল। নজরুল সেখানে একেবারে যাচ্ছেতাই, সরল আর সোজাসাপটা, ‘চার্মহীন’। সাম্য আর শোষণহীনতা, মানবিক মর্যাদা আর অসাম্প্রদায়িকতা তাঁর দর্শন। এসব নিয়ে তাঁর দ্ব›দ্ব-দ্বৈরথ আছে, লুকোছাপা নেই। তাঁর চেতনার টান আবার জল-কাদার দেশ বঙ্গ-গৌড় থেকে পারসিক-আরবীয় দুনিয়া পর্যন্ত। ভাটিয়ালির পাশাপাশি ইরান-তুরানের সুরেও তাঁর আগ্রহ। বাঙালি মধ্যবিত্তের রুচির যে অবস্থা, প্রগতিশীলতা নিয়ে যত নিম্নমানের ধারণা আর হীনম্মন্যতা তাঁদের, তাঁরা বোঝেন, তাঁদের অলস মস্তিষ্কের ছোট্ট খুপরিতে ধরতে পারার মতো জিনিস নজরুল কোনো দিনই নন।
‘নিচু তলার লোকেদের’ সমস্যাটা ভিন্ন। তাঁরা কবির নামটা জানেন। পড়া হয়নি কিছুই, তবু ‘মুসলমানের ছেলে’ বলে গর্ববোধ হয়। নজরুলের কবিজীবনে ‘কলঙ্কের মতো’ সেঁটে থাকা ‘বিদ্রোহী’ অভিধাটা তাঁদের ভালো লাগে। ‘দুখু মিয়া’ শুনলেই আপন-আপন লাগে। রোয়াকের আড্ডায় কিংবা ওয়াজ-মাহফিলে শোনা রবিবাবুর সঙ্গে তুলনা করে তাঁরা বুঝতে চান, কাজী সাহেব তাঁর চেয়ে কত বড় কবি? রবীন্দ্রনাথ যে কখনো হিন্দু ছিলেন না, সেটাও তারা জানেন না। তাঁর রচনাও তো দেখা হয়নি চোখে। তবু তাঁর চেয়ে নজরুল কতটা বড়, সেটা বুঝতে না পারলে তাঁদের হাঁসফাঁস লাগে। ‘এক পুস্তকের পাঠকেরা’ সেই সুযোগটা নেন। নজরুলের হামদ, নাত আর কতগুলো গজল মুখস্থ করে, তারই আলোকে খাঁটি ইসলামি কবি হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁরা প্রাণান্ত করেন। অথচ তাঁরা জানেন না কিংবা জানলেও বলেন না যে নজরুল প্রচুর শ্যামাসংগীতও লিখেছেন। জীবনের এক পর্যায়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কালীভক্ত। আর তাঁরই বন্দনা করে রচনা করেছেন ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, দেখে যা আলোর নাচন’ কিংবা ‘কালী কালী মন্ত্র জপি বসে শোকের ঘোর শ্মশানে’র মতো গানগুলো। হানাহানিকারীদের নজরুল কল্পনা করেছেন ‘পশু’ প্রতীকে। বলেছেন, ‘দুই পশুর হাতে মার খাইতেছে দুর্বল মানুষ। ইহারা মানুষকে মারিতেছে যেমন করিয়া বুনো জঙ্গি বর্বরেরা শূকরকে খোঁচাইয়া মারে। উহাদের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, উহাদের প্রত্যেকের মুখ শয়তানের চেয়েও বীভৎস, শূকরের চেয়েও কুৎসিত। হিংসায়, কদর্যতায় উহাদের গাত্রে অনন্ত নরকের দুর্গন্ধ।’ এসব না জেনে বা জেনেও না বলে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ কিংবা ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’-এ ধরনের কিছু গান শুনে এবং শুনিয়ে নজরুলকে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে চান ‘ইসলামের দূত’ হিসেবে। অথচ তাঁদেরই জ্বালায় একদা অস্থির ছিলেন কবি। ‘কাফের কাজী’ বলে ফতোয়া পেয়েছিলেন। এখন নতুন ফতোয়া দিয়ে কবিকে তাঁরা ‘খাঁটি মুসলমান’ হিসেবে দেখাতে চান। জোর-চিৎকার করে দাবি করেন, তিনিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবি। আর কোনো কবিকে তাঁদের দরকার নেই, রবীন্দ্রনাথকে তো একেবারেই নেই। এসব বয়ানে বুঁদ হয়ে সরল-সাদা মানুষেরা উদ্বুদ্ধ ও উত্তেজিত হন, তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, আর কল্পনার অলীক এক জগতে কবিকে সমাহিত রেখে আরামে নিদ্রা যান।
অধ্যাপক ও সমালোচক মহলের সমস্যাটা আরও গুরুতর। প্রতিষ্ঠিত মতবাদ আর মুখস্থ বুলির দেয়াল টপকে নজরুলের লেখামালার মর্মবস্তুর কাছে তাঁরা পৌঁছাতে পারেন না। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে বলেছেন-‘বালক প্রতিভা’। তারপর আরও অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আরও অনেক অভিধাই যুক্ত করেছেন। সব মিলিয়ে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে গীতিকার হিসেবে খানিকটা গ্রাহ্য হলেও কবি বা লেখক হিসেবে নজরুল যেন কিছুই নন। অথচ ইসলাম-হিন্দু-গ্রিক পুরাণকে আত্মস্থ করতে গাঁওগেরামের মানুষটি অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। সেসবের সারকথা জেনে দর্শনসহ কবিতায় উল্লেখ করতে এবং যথার্থ প্রতীক-রূপকসহ কাব্যরূপে ব্যবহারের সহজতা আনতে নিখুঁতভাবে তিনি আয়ত্ত করেছেন বাংলার সবচেয়ে জটিল ছন্দ সরল-কলামাত্রিক আর মাত্রাবৃত্তের নানা চাল। আরবি-ফারসি থেকেও ছন্দ-অলংকার তুলে এনেছেন দুহাত ভরে। ‘মোতাকারেব’, ‘রবজ’ আর ‘ওয়াফ’-এর মতো আরবি ছন্দগুলো রপ্ত করে বাংলা কবিতায় প্রয়োগ করতে গিয়ে তাঁর হাত কখনো কেঁপে ওঠেনি। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি আর বাংলা শব্দকে বিভিন্ন ভাষার বিচিত্রসব ছন্দে এবং নিখুঁত ছত্রে ও ছত্রান্তে রূপায়িত করে কবিতার এমন এক ভুবন তিনি নির্মাণ করেছেন, পরাধীনতা আর অসাম্যের পবিত্র ক্রোধের প্রকাশরূপ পরিগ্রহ করে সেগুলো হয়ে উঠেছে অভূতপূর্ব আনন্দের ধারক। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ঔপনিবেশিক ছকের মধ্যে বেড়ে ওঠা সমালোচকেরা, দূষিত বিদ্যা আর দুর্বল প্রগতিশীল মন নিয়ে তার কূল পান না। ফলে মুখস্থ অভিধা আর আজগুবি অভিযোগ তুলে এড়িয়ে যান।
এসব কারণে বেঁচে থাকতেও নজরুলকে বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে অনেক। মতাদর্শে মোহগ্রস্ত লোকেরা সেদিনও তাঁকে বুঝতে পারেননি, আজও বোঝেন না। কোনো শ্রেণিরই স্বার্থানুকুল মাপজোখের হিসেবে পুরোটা খাপ খান না তিনি। এ নিয়ে অস্বস্তি আছে, উপেক্ষার উপায় নেই। মহাপ্লাবনের মতোই তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলো এতটাই দিকপ¬াবী যে মানবতার লাঞ্ছনা দেখলেই সব ভেঙেচুরে ঘাড়ের ওপর আছড়ে পড়ে। তখন বাধ্য ও বিব্রত হয়ে তাঁকে গ্রাহ্য করতে হয়। অতিচালাক লোকেরা তখন তাঁর নামে প্রচলিত অনেক অভিধার মধ্য থেকে সুবিধামতো একটা বেছে নিয়ে বাকিগুলো ছুড়ে ফেলেন। ওইটুকু দিয়েই তাঁকে বুঝতে চান তাঁরা এবং প্রত্যাশা করেন, অন্যরাও অতটুকুই বুঝুক। তার ব্যতিক্রম হলেই হইচই হয়, গায়ের জোরে হলেও সেটুকুকেই সবটুকু বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। ফলে এই জনজীবনের কোনো ক্ষেত্রেই এখনো তাঁকে পুরোপুরি গ্রহণ করা যায়নি। নিজের লাভের অংশটুকু নিয়ে বাকিটা ফেলে দেওয়ার কারণে জাতীয় কবির আসলটুকুই আসলে বাদ পড়ে গেছে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *