মধুসূদন দত্তের সাহিত্য বিদ্রোহ ও দেশপ্রেম

মধুসূদন দত্তের সাহিত্য বিদ্রোহ ও দেশপ্রেম

শাহরিয়ার কবির
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ২০০ বছরের পাঠ পরিক্রমায় মাইকেল মধুসূদন দত্তকে (১৮২৪-১৭৮৩ খ্রি.) আমরা দেখি প্রথম সংস্কারবিরোধী আধুনিক কবি ও নাট্যকার রূপে, যিনি বাংলা কাব্য রচনার প্রচলিত ধারা বদলে দিয়েছেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করে। একই সঙ্গে আধুনিক বাংলা নাটক রচনা এবং মঞ্চে প্রদর্শনের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলামকে সংগত কারণে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে বিষয় ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে প্রথম বিদ্রোহ করেছেন মাইকেল।
শুধু সাহিত্যে নয়, প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করেছিলেন রামমোহন-ডিরোজিও যুগের নবজাগরণের এই নায়ক। মাইকেলের এই বিদ্রোহকে আরো মহিমান্বিত করেছে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি তাঁর গভীর প্রেম।
বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়িতে। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার বিত্তবান আইনজীবী, ফারসি ভাষায় পারদর্শী। শৈশবে পিতার কাছে শিখেছিলেন ফারসি ভাষা, একই সঙ্গে মাতা জাহ্নবী দেবীর কাছে পাঠ গ্রহণ করেছেন রামায়ণ, ‘মহাভারত’-এর মতো ধ্রুপদি সাহিত্যের।
মধুসূদন যে সময়ে জন্মেছেন এর কিছুকাল আগে কলকাতায় ধর্মীয় অনাচার ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সমাজ ও শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.), যার ধারাবাহিকতায় হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রি.) পশ্চিমের রেনেসাঁর ধারায় যাবতীয় রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় প্রথার বিরুদ্ধে বাংলায় আরম্ভ করেছিলেন নবজাগরণের আন্দোলন। ১৭ বছর বয়সে ডিরোজিও কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং মাত্র পাঁচ বছরের ভেতর তিনি ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন, লেখালেখি ও বক্তৃতার মাধ্যমে কলকাতার বিদ্বৎসমাজে, বিশেষভাবে তরুণদের চিন্তার জগতে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ডিরোজিওর মৃত্যুর কিছুদিন পর মধুসূদনের পিতা রাজনারায়ণ দত্ত সপরিবারে কলকাতার খিদিরপুরে তাঁর নিজস্ব বাসভবনে চলে আসেন।
সাত বছর বয়সে মধুসূদন প্রথমে স্কুলে, এর দুই বছর পর হিন্দু কলেজের নিম্ন শ্রেণিতে ভর্তি হন। এক বছরের ভেতর বাংলা ও ফারসির পাশাপাশি তিনি ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। যে সময়ে হিন্দু নারীদের সতীদাহ প্রথা রোধের জন্য রামমোহন রায়কে আন্দোলন করতে হয়েছে, সে সময় নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর প্রবন্ধ লিখে হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষার্থী মধুসূদন দত্ত স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
মধুসূদনের সতেরো বছর বয়সে লেখা এই প্রবন্ধে নারী সম্পর্কে ধর্ম ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনোভাবের সমালোচনা যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে নারীর ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধও বিধৃত হয়েছে। নারীর এই মর্যাদা এবং একই সঙ্গে নারীর দ্রোহ মূর্ত হয়েছে মধুসূদনের কালজয়ী সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘শর্মিষ্ঠা নাটক’, ‘পদ্মাবতী নাটক’, ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ এবং ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাপটিভ লেডি’ ও ‘রিজিয়া’ নাটকে।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ছাড়া মধুসূদনের অন্য সব কাব্যগ্রন্থ ও নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর নায়ক পুরুষ হলেও তার সহধর্মিণী প্রমিলাকে তিনি নির্মাণ করেছেন সাহস, মর্যাদা ও দ্রোহের মূর্ত প্রতীক হিসেবে, যিনি ভগবান রামের বিরুদ্ধে উদ্ধত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘কী কহিলী বাসন্তী!/ বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশ্য/কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?/দানব-নন্দিনী আমি, রক্ষ-কুলবধূ,/রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,/আমি কি ডরাই কভু ভিখারী রাঘবে?’
হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালেই মধুসূদন দত্ত হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও তাঁর বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় পাওয়া যাবে। বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠি এবং তার জীবনীকারদের রচনা থেকে বোঝা যায় খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকর্ষণের চেয়ে রূপসী, বিদুষী খ্রিস্টান নারীর প্রতি ভালোবাসা এবং বিলেত যাওয়ার বাসনাই ছিল এই ধর্ম পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। কোনো আচার ধর্মের প্রতি অনুরাগ কখনো তাঁর ছিল না।
মাইকেলের ধর্ম পরিবর্তনের আরেকটি কারণ হচ্ছে-তিনি সব সময় একজন শিক্ষিত আলোকিত নারীকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পেতে চেয়েছেন, যা তৎকালীন হিন্দু সমাজে ছিল না বললেই চলে। অধ্যাপক ক্ষেত্র গুপ্ত লিখেছেন, ‘রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেবকী নাম্নী রূপবতী বিদুষী দ্বিতীয় কন্যার সঙ্গে মধুসূদনের প্রেম সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এমন সংবাদ পাওয়া যায়।… কবির খ্রিস্টান হওয়ার কিছুদিন আগে একটি গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা উঠেছিল। কবির তা মোটেই পছন্দের ছিল না। তা থেকে উদ্ধারের একটি সহজ উপায় খুঁজে পেলেন ধর্মান্তর গ্রহণের মধ্যে।’ (মধুসূদন রচনাবলি, সাহিত্য সংসদ কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ ১৯৯৯)
হিন্দু কলেজে কোনো অহিন্দু ছাত্রের পড়ার অধিকার ছিল না। খ্রিস্টান মধুসূদন হিন্দু কলেজ ছেড়ে বিশপ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে গিয়েও কলেজের বহু বর্ণবৈষম্যমূলক নিয়ম-কানুন, যা তাঁর পছন্দ ছিল না সেসবের প্রতিবাদ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এক পর্যায়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর দাবি মেনে নিয়ে বহু বিধি-নিষেধ সংশোধনও করেছিল। বিশপ কলেজে কয়েক বছর পড়ার খরচ মধুসূদন পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন, ১৯৪৮ সালে হঠাৎ যা বন্ধ হয়ে যায়। মধুসূদন কলকাতায় উপযুক্ত চাকরি না পেয়ে মাদ্রাজ চলে যান। সেখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি সংবাদপত্রে কলাম লিখে বিদ্বজ্জনদের মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। মাদ্রাজে থাকাকালে তাঁর প্রথম ইংরেজি গ্রন্থ ‘ক্যাপটিভ লেডি’ প্রকাশিত হয়। সে সময় ইংরেজি অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘রিজিয়া’ নামে একটি নাটকও তিনি লিখেছিলেন।
মাদ্রাজে গিয়েই মধুসূদন প্রেমে পড়েছিলেন রেবেকা ম্যাক্টাভিসের। অনেক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে রেবেকাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়ের সময় তাঁকে মাইকেল নাম গ্রহণ করতে হয়েছিল। মাইকেলের এই দাম্পত্য জীবন যে সুখের ছিল না তার কিছুদিন পরই প্রমাণ পাওয়া গেল হেনরিয়েটার সঙ্গে তাঁর প্রেমের ঘটনা জানাজানি হওয়ায়।
১৮৫৬ সালে পিতৃবিয়োগের সংবাদ শুনে রেবেকা এবং তাঁর সন্তানদের ত্যাগ করে মাইকেল হেনরিয়েটাকে নিয়ে কলকাতা ফিরে এলেন। জ্ঞাতিদের সঙ্গে মামলা করে পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করলেন।
এই কলকাতাবাসের সময় আরম্ভ হয় তাঁর প্রকৃত সাহিত্য সাধনা। সেবার তিনি কলকাতায় ছিলেন মাত্র ছয় বছর। তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্যসম্ভার এ সময়ে রচিত। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘শমিষ্ঠা’ নাটকের প্রথম সংস্করণের প্রস্তাবনায় একটি গান ছিল, যার শেষ স্তবকে তিনি লিখেছিলেন, ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে/মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে,/ নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।/সুধারসে অনাদরে/বিষবারি পান করে/তাহে হয় তনু মনঃ ক্ষয়।/মধু বলে জাগ মা গো,/বিভু স্থানে এই মাগ,/সুরসে প্রবৃত্ত হউক তব তনয় নিচয়।’ (প্রাগুক্ত) মধুসূদন এভাবেই বাংলা নাট্য সাহিত্যে সুরসের প¬াবন বইয়ে দিয়েছিলেন।
১৮৬০ সালে মধুসূদন লিখেছেন প্রহসনমূলক নাটক ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘পদ্মাবতী’ নাটক ও ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। ১৯৬১ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় মধুসূদনের অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। মিলটনের মহাকাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর প্রেরণায় বাংলা ভাষার প্রথম মহাকাব্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের অঙ্গনে ঝড় তুলেছিল।
মাইকেলের আশৈশব স্বপ্ন ছিল বিলেত গমনের। ১৯৬৩ সালে যখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে তখন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডন গিয়ে ‘গ্রেজ ইন’-এ যোগ দেন। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি যথেষ্ট সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। তবে লন্ডন যাওয়ার আগে তাঁর অবর্তমানে যাদের তিনি সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা তাদের দায়িত্ব পালন না করায় তিনি সমূহ আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন। খরচ বাঁচানোর জন্য তিনি স্ত্রী হেনরিয়েটা ও পুত্র-কন্যাদের নিয়ে ফ্রান্সে চলে গিয়েছিলেন। এ সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, গৌরদাস বসাক ও রাজনারায়ণ বসুর মতো সুহৃদদের কাছে অর্থ সাহায্যের জন্য তাঁকে হাত পাততে হয়েছিল।
১৮৬৭ সালে বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে মাইকেল দেশে ফিরেছিলেন। আইন ব্যবসায় তাঁর যথেষ্ট অর্থাগম হলেও তাঁর ব্যয় ছিল আয়ের বেশি। ১৮৭০ সালে মাইকেল হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিলের অনুবাদ বিভাগের পরীক্ষক হিসেবে সে আমলে দেড় হাজার টাকা বেতন পেতেন, কিন্তু এতেও তার ব্যয় নির্বাহ হতো না। বন্ধুবৎসল, অমিতব্যয়ী, উদ্দাম, বিদ্রোহী জীবনযাপন তাঁকে শারীরিকভাবেও জীর্ণ করে ফেলেছিল। শেষ জীবনে কিছু সনেট ছাড়া ‘মায়াকানন’ নামে একটি নাটক সম্পূর্ণ করেছিলেন। ‘হেকটরবধ’ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি।
১৮৭৩ সালের ২৯ জুন চরম অর্থাভাবে মৃত্যুর দেড় বছর আগে মাইকেল ঢাকা এসেছিলেন। ঢাকাবাসী তাঁর জন্য নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। অভিনন্দনপত্রে বলা হয়েছিল, ‘আপনার বিদ্যাবুদ্ধি ক্ষমতা দ্বারা আমরা যেমন মহা গৌরবান্বিত হই, তেমনি আপনি ইংরেজ হইয়া গিয়াছেন শুনিয়া আমরা ভারি দুঃখিত হই, কিন্তু আপনার সঙ্গে আলাপ ব্যবহার করিয়া আমাদের সে ভ্রম গেল।’ (প্রাগুক্ত)
এর উত্তরে মাইকেল বলেছিলেন, ‘আমার সম্বন্ধে আপনাদের আর যেকোনো ভ্রমই হউক, আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারি অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার কক্ষে এক একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার ইচ্ছা (যখনই) বলবৎ হয় অমনি আর্শিতে মুখ দেখি। আরো, আমি সুদ্ধ বাঙ্গালি নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটি যশোহর’। (অমৃতবাজার, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২)
মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মের ২০০ বছর পর যখন তাঁকে স্মরণ করি তাঁর সাহিত্যকীর্তি, বিদ্রোহী সত্তা ও দেশপ্রেম যেমন বিমুগ্ধ, বিস্মিত ও অভিভূত করে, একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ করে-এখনো আমাদের লড়তে হচ্ছে ধর্মের নামে যাবতীয় অনাচার, কুসংস্কার ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।
ডিরোজিও আর মাইকেলের মতো মুক্তচিন্তার বিদ্রোহীরা মৌলবাদের তামসিক অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন ও সংগ্রামে প্রেরণার অফুরন্ত উৎস হিসেবে বিরাজ করবেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *