সুর তাপস ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ – করিম হাসান খান

সুর তাপস ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ – করিম হাসান খান

আত্মবিস্মৃত এক জাতি আমরা। খুব সহজেই জীবনপাতা থেকে হারিয়ে ফেলি কত গুণী, স্মরণীয়-বরণীয় মহামণিষীদের। তেমনই একজন উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সুর তাপস ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ সাহেব (১৮৬২-১৯৩৩)। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রামের নাম শিবপুর, তদানীন্তন ত্রিপুরা জেলার, নবীনগর থানার অন্তর্গত ছায়া সুনিবিড় এ গ্রাম ছিল ত্রিপুরা রাজার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে। একদা পিতা সঙ্গীতজ্ঞ সফদার হোসেন খাঁ-এর হাত ধরে ত্রিপুরা রাজদরবারে হাজির হন ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ।
রাজ দরবারের সঙ্গীত জলসায় বাঁশির সম্মোহনী পরিবেশনায় সবাইকে মোহিত করেন, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর সুখ্যাতি। সেই থেকে রাজ পরিবারের বিশেষ নজরে চলে আসেন তিনি। বাঁশিতে তাঁর সম্মোহনী যাদু ছিল বটে, তবে তবলা, হারমোনিয়াম, দোতারা, মেঘডম্বুর (তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র)সহ অনেক সঙ্গীত যন্ত্রের উপর পারদর্শিতা ছিল। পাশাপাশি ছিলেন কণ্ঠশিল্পী। তিনটি যন্ত্র তিনি একসাথে বাজিয়ে গান করতেন।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ছিল অগাধ পান্ডিত্য। সেসময় গোটা ত্রিপুরাসহ এতদঞ্চলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন অবলীলায়। আর সেভাবেই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে সুর তাপস, সাধক, ফকির, প্রফেসর, গুণাকর ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিষিক্ত করে। বাংলা গানে আরেক বিস্ময় মলয়া সঙ্গীত যার রচয়িতা মহর্ষী মনোমোহন দত্ত (১৮৭৭-১৯০৯) গুরুর বাণীকে বিভিন্ন রাগ-রাগিনির সংমিশ্রণে সুর যোজনায় লোকসঙ্গীত ধারায় এক নবদিগন্তের সূচনা করেন সুর তাপস ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ সাহেব।
অর্থাৎ মহর্ষী মনোমোহন দত্তের গানের শতভাগ সুরকার ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ। শুধু সুরকার বললে ভুল হবে তিনিই প্রথম মলয়া সঙ্গীত স্বকণ্ঠে ধারণ করেন এবং গ্রাম-গ্রামান্তর লোক-লোকান্তরে গানগুলো গেয়ে গেয়ে জনমানুষের দুয়ারে দুয়ারে নিয়ে যান। সেসময়ে ত্রিপুরাসহ বৃহৎ বাংলায় তাঁর সুখ্যাতি ছিল আকাশ ছোঁয়া। কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গেয়ে শোনান “মন মাঝে যেন কার ডাক শোনা যায়” বিশ্বকবি গান শ্রবণে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন এ কার গান, উত্তরে ফকির সাহেব বললেন আজ্ঞে মহর্ষী মনোমোহন দত্তের লেখা। বিশ্বকবির স্বভাবসুলভ অভিব্যক্তি “এই গান রচয়িতা আত্মাকে জানিয়াছে”।
বিশ্বকবি ফকির সাহেবকে আহ্বান জানান “তুমি যখনই কলকাতায় আসবে আমাকে গান শোনাবে”। ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ সাহেব ছিলেন মহর্ষী মনোমোহন দত্তের আত্মা, তাই তিনি মনোমোহনে নিমগ্ন ছিলেন। নাম যশ বা সম্পদ কোনো কিছুই ফকির সাহেবকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তিনি ছিলেন সুরের ওলী। আধ্যাত্মিক সাধক ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ সুরের মাধ্যমে স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন আজীবন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবেসেছেন, সব ধর্ম সমন্বয়ের মাধ্যমে বিশ^ মানবতাকে এক কাতারে শামিল করবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, ছিলেন সমাজ সংস্কারক। মলয়া সঙ্গীতের সুর যোজনায় তিনি অজস্র রাগ-রাগিনীর আশ্রয় নিয়েছেন।
তার মধ্যে প্রধানত ভৈরবী, খাম্বাজ, পিলু, বারোয়াঁ, তিলক-কামোদ, যোগ, তিলং, ললিত, সিন্ধু ভৈরবী, ঝিঁঝিট, বাগেশ্রী, টৌড়ি, বসন্ত বাহার, সোহানী, ভুপালী, কালেংড়া, আশাবরি, মালকোষ, মুলতানী, কেদার, ছায়ানটসহ অনেক রাগ যার তালিকা করতে গেলে পরিসর হবে সুদীর্ঘ। তেমনি তাল-লয়ের যে অসাধারণ গাঁথুনি তা ভারতীয় সঙ্গীতে রেখেছে অনন্য ভূমিকা।
আমরা ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ সাহেবের শিষ্য শচীন দেব বর্মনের সুরে এবং গায়কিতে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাই। সচিন কর্তার সান্নিধ্যে ধন্য সন্তান আর ডি বর্মন হয়ে উঠেন উপমহাদেশের সঙ্গীতে লয়ের রাজা। উল্লেখ্য শচীন কর্তা পরবর্তীতে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছেও দীর্ঘ তালিম গ্রহণ করেন। দুটি বিষয়ে আমি বিস্মিত প্রথমত সেসময়ে তিনি এতো রাগ-রাগিনি কীভাবে আত্মস্থ করলেন, দ্বিতীয়ত রাগ-রাগিনি যোজনায় কেমন করে সুমধুর লোক আঙীকের ধারা সৃষ্টি করলেন। যে সুরগুলো ঘুরে ফিরে নানাভাবে নানা মাধ্যমে আজও আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তেমনই কয়েকটি গান
১। আঁখি নিরে টেনে আনে, প্রাণের প্রাণ কাছে, কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু- শাহ আবদুল করিম
২। গায়েবি আওয়াজ কয় শুনরে মুসলমান, পিয়া পিয়া পিয়া পাপিয়া পুকারে – নজরুল সঙ্গীত
আওগে যব তুম সাজনা- রশিদ খান, হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়-মেহেদি হাসান
৩। আমি কি তার সঙ্গ ছাড়া হই, উচাটন মন ঘরে রয় না-নজরুল সঙ্গীত
৪। আমি পারলেম না স্বভাব বানাতে, মনের দুঃখ মনে মনে রইল রে চিনলি নারে সোনার চান-শিল্পী বারি সিদ্দিকী
আমি উপমা হিসেবে মাত্র কয়েকটি গান উল্লেখ করেছি। প্রকৃত তালিকা আরো দীর্ঘ। উল্লেখ্য, মলয়া সঙ্গীতভূক্ত এ গানগুলো ১৯০০ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে সৃষ্ট বলে প্রতীয়মান। যা বলছিলাম ত্রিপুরা রাজ দরবারে তিনি যারপরনাই একটি সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যখন যুবরাজ শচীন দেব বর্মন ফকির সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আর তাইতো কণ্ঠ, সুর, তাল লয়ের যাদুকরি যোজনায় হয়ে গেলেন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের বরপুত্র শচীন কর্তা। ভারতীয় সঙ্গীতের আরেক দিকপাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গিরিন চক্রবর্তী, তিনিও ছিলেন ফকির আফতাবউদ্দিনের সুযোগ্য শিষ্য।
সবশেষে বলতে হয়, শিবপুর খাঁ পরিবারের তিনি ছিলেন সকলের গুরু। তাঁর সান্নিধ্যে ছোট ভাই আলম হয়ে যান সুর সম্রাট বাবা আলাউদ্দিন খাঁ যিনি শিবপুরকে নিয়ে যান বিশ্ব দরবারে। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ থেকে শুরু করে ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, বাহাদুর খাঁ, রাজা হোসেন খান, মীর কাসেম খান, আবেদ হোসেন খান, শাহাদত হোসেন খানসহ পরিবারের এমন কেউ নেই যে বিশ্ব দরবার স্পর্শ করেননি। একটি পরিবারে বৃটিশ, ভারত, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে প্রায় ৪৫টি পদক প্রাপ্তি সারা দুনিয়াতে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
ক্ষণজন্মা সুর তাপস গুণাকর ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ সাহেবের ৯১তম প্রয়াণ দিবস ২৬শে জানুয়ারী ২০২৪। প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে বরাবরের মতো এবারও ২৫, ২৬, ২৭ জানুয়ারী তিন দিনব্যাপী ওরসের আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে প্রথম দিন দোয়া মাহফিল, দ্বিতীয় দিন সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং শেষ দিন রাতব্যাপী বাউল সঙ্গীতের আয়োজনে অসংখ্য ভক্ত অনুরাগীগণ মিলিত হয়ে থাকেন এক মিলন মেলায়।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *