পরাবাস্তববাদী মরমি কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার

পরাবাস্তববাদী মরমি কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার

মাসুদুজ্জামান: ‘কবিতা আমাদের জাগাতে চায়, ঘুম পাড়াতে নয়…’ জীবন যেন শিকড়িত হয়ে আছে চারপাশে ছড়ানো প্রকৃতিতে। প্রকৃতির এই শুশ্রæষা আর বাস্তব জীবনের রূঢ়তা, এরই মাঝ দিয়ে মানুষের নিরন্তর চলা। স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকে আমাদের জীবন, অথবা হারিয়ে যেতে যেতে আবার হয়তো এই জীবনকেই ফিরে পায় মানুষ। ব্যক্তিক আত্মসত্তা এভাবেই আধুনিককালে নানা সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।

প্রকৃতি থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কোনো কিছুকেই সে আর সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তার জীবনের সঙ্গে যা কিছু জড়িয়ে আছে, তার সব কিছুকেই মনে হয়েছে তার আত্মসংকটের জন্য দায়ী। কিন্তু এটাই যে শেষ কথা নয়, সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা পড়লেই সেটা বোঝা যায়।

আধুনিক জীবনে মানুষ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে ঠিকই, তবে প্রকৃতি এখনো মানুষকে দিতে পারে আত্মমুক্তির সন্ধান। ট্রান্সট্রোমারের কবিতার এটাই হচ্ছে মূল বৈশিষ্ট্য।

আত্মজৈবনিকতাই কি আধুনিক কবিতার মর্মবাণী? নিজেকে নিয়ে কবিতা লেখার বিষয়টা এভাবেই তো কবির কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ট্রান্সট্রোমারের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি এর।

ছেলেবেলায়ই অনেক গ্রীষ্ম তার কেটেছে রুমারো নামের একটা দ্বীপে। দ্বীপময় এই ভূ-প্রকৃতি যে আজীবন কতভাবে ট্রান্সট্রোমারের কবিতাকে প্রভাবিত করেছে, তার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের নানা কবিতায়, আত্মজীবনীর টুকরা লেখায়।
প্রকৃতির আছে রূপ, রস, বিভঙ্গ। নানা আকার, রূপ-রূপান্তর-বৃষ্টিপতনের শব্দ, পাতার মর্মর, পাহাড়ের গম্ভীর স্তব্ধতা, ঢেউয়ের ছান্দসিক চলা। প্রকৃতির এই রূপময়তা আর ছন্দের টানে চিত্রকলা আর গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন এই কবি।

প্রবল আগ্রহ ছিল কীটতত্ত¡, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, চিত্রকলা আর সংগীতে-বিশেষ করে পিয়ানোর প্রতি তাঁর আসক্তি আজীবনের। ট্রান্সট্রোমারের কাছে বস্তুজগৎ নয়, অনুভূত জগৎই কবিতার বিষয়-আশয় হয়ে উঠেছে। ফলে বস্তুপৃথিবীর জমকালো বর্ণনা থাকে না তাঁর কবিতায়, থাকে অবভাসিক জগতের কথা, আত্ম-অনুভবের কথা। ফলে তাঁর কবিতায় বর্ণনার ঐশ্বর্যের পরিবর্তে পাওয়া যায় অনুভূত সৌন্দর্যের মনোজাগতিক গহনছবি, ইমেজ বা প্রতিমার চমকপ্রদ ব্যবহার। তাঁর কবিতার ভাষাভঙ্গি খুবই সরল। যে প্রতিমা তিনি নির্মাণ করেন, তা-ও তাঁর নির্মিত প্রতিমা, বস্তুপৃথিবীতে তার দেখা মিলবে না। মহৎ সৃষ্টিশীল কবির এটাই তো প্রধান লক্ষণ। তাঁর নির্মিত কবিতার জগৎ এভাবেই বোধ নয় বোধি, সংবাদভাষ্য নয় সংবেদনা সৃষ্টির সূত্রে ছুঁয়ে দেয় পাঠকের হৃদয়। তাঁকে যথার্থই আখ্যায়িত করা হয়েছে ইমপ্রেসনিস্ট বা প্রতীতিধর্মী, পরাবাস্তববাদী কবি হিসেবে।

তাঁর কবিতার ভুবন সুইডেনের দ্বীপাঞ্চল, পাহাড়, বন-বনানী, পাখি, কীটপতঙ্গ, সমুদ্র, বিস্তীর্ণ সমভূমি। তবে প্রতিটি কবিতার কেন্দ্রে আছে একজন ‘আমি’, দার্শনিক পরিভাষা ব্যবহার করে বলা যায় আত্মসত্তা (সেলফ) হচ্ছে তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। বাস্তব ও অবাস্তব বিষয়কে চমৎকারভাবে কবিতায় মিশিয়ে তিনি তৈরি করেন নিজের কবিতার তৃতীয় ভুবন। একদিকে অদেখা ঈশ্বর, দেবদূত; অন্যদিকে ছোট্ট একটা পিঁপড়া বা অতিকায় সামুদ্রিক পাখির কথার মিশ্রণে গড়ে তোলেন স্বপ্নকল্পময় ধ্যানমগ্ন কবিতার জগৎ। মানুষের গৌরবগাথাই তাঁর কবিতাকে করে তুলেছে তীব্রভাবে মানবিক।

আধুনিক কবিরা আধুনিকতার অভিঘাতে যেখানে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, সেখানে ট্রান্সট্রোমারের কবিতা জীবনাসক্তি, ভালোবাসা আর প্রেমের অভিজ্ঞানে উজ্জ্বল। ‘গৃহাভিমুখী’ শীর্ষক একটা কবিতায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আমি হচ্ছি সেই কম্পাসের কাঁটা, যাকে কোনো কম্পাসবাহক/দুরুদুরু হৃদয়ে বয়ে নিয়ে চলেছে বনে।’ আরেকটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যা কিছু ভালো, তা দিয়েই পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে চান আর কবিতা যোগাযোগ স্থাপন করে সত্যের সঙ্গে।

আধুনিককালের সঙ্গে খুবই বেমানান নন কি এই কবি, যিনি সত্যের কথা বলেন, জীবনাসক্তির কথা তুলে ধরেন তাঁর কবিতায়? কথাটা সত্যি, আধুনিক জীবনের যত ক্লেদ, বিবিক্তি, নির্বেদ, হতাশা আছে; আমাদের জীবনকে যা নিরর্থক করে তুলছে, তা থেকে নিজেকে রক্ষা করে রচনা করেছেন শান্ত, সুন্দর, ধ্যানমগ্ন ইতিবাচক কবিতা। ট্রান্সট্রোমারকে তাই সহজেই শনাক্ত করা যায় প্রচণ্ড আশাবাদী এক কবি হিসেবে। তবে এই আশাবাদের উৎস হচ্ছে মানুষ, যে মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসেন। কিন্তু শুধুই কি মানুষ? কীটপতঙ্গ, প্রকৃতি-এসবও তো তাঁকে তীব্রভাবে আলোড়িত করেছে। তবে সরলরৈখিক নয় তার ভাবনা, জীবনের জটিলতা, বিনষ্টিকে ছুঁয়ে দিয়েই ইতিবাচক জীবনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন কবিতাকে। এই জীবনের কথাই পাওয়া যায় ‘চিঠির উত্তর’ শীর্ষক একটা কবিতায় এভাবে: ‘সময় কোনো সরলরেখা নয়। এটা গোলকধাঁধার চেয়েও অধিক কিছু। আর তুমি যদি দেয়ালের খুব কাছাকাছি ঠিক ঠিক জায়গায় চলে আসো, তাহলে শুনতে পাবে দ্রুত ধাবমান পদশব্দ আর কণ্ঠস্বর, শুনতে পাবে দেয়ালের অন্য পাশ দিয়ে তুমি নিজেই হেঁটে যাচ্ছ।’ কী চমৎকারভাবেই না এখানে ট্রান্সট্রোমার বৌদ্ধিক আর আবেগিক অনুষঙ্গকে মিশিয়ে দিলেন। এই হচ্ছে তাঁর কবিতা, যেখানে গভীর সংকটের মধ্যেও জীবনকে ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র আর্তি ঝরে পড়ে: ‘খুব তাড়াতাড়ি বোধ হয় এখানে এসে গেছি, রাস্তা পেরোনোর আগেই, কোনো কিছু বোঝার আগেই। জীবনকে এ জন্য ধন্যবাদ! এখনো বিকল্প যা কিছু তাকে হারিয়ে ফেলি। যত টুকরা ছবি, স্কেচ-সব কিছুই বাস্তব হয়ে উঠতে চায়।’ জীবন এ রকমই জীবনের অতিরিক্ত কিছু, যে জীবনের সঙ্গে আশ্লেষে-ভালোবাসায় জড়িয়ে আছে মানুষ। জীবনকে অনুভব করতে হলে তাই জীবনকে ছাড়িয়ে যেতে হয়। ট্রান্সট্রোমারের কবিতাও সেদিকেই নিয়ে যায় পাঠককে, বৃহৎ কোনো বোধের দিকে। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, অন্য মানুষ, পরাপৃথিবীর সহযোগেই মানুষের জীবন অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। সহজেই তাই তাঁর কবিতাকে প্রকৃতিভাবাপন্ন কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রকৃতি এখানে প্রধান নয়, প্রধান হচ্ছে মানুষ, তবে প্রকৃতি গ্রহণ করে মানবীয় ভূমিকা। ‘সংগোপনে পথে’ কবিতাটি তো এই ভাবানুষঙ্গে রচিত। তাঁর কবিতা অভূতপূর্ব সব ইমেজের পর ইমেজে সজ্জিত। একটি-দুটি স্তবক নয়, কখনো কখনো পুরো কবিতাই হয়ে উঠেছে ইমেজময়। রহস্যময়তা, বিজ্ঞানমনস্কতাও তাঁর কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে। বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে বিরোধাভাস সৃষ্টি, বৃহতের সঙ্গে ক্ষুদ্রের, কাছের সঙ্গে দূরের, জীবনের সঙ্গে জড়ের, তন্ময়তার সঙ্গে মন্ময়তার, বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার, বিজ্ঞানের সঙ্গে কাব্যিকতার, মূর্তের সঙ্গে বিমূর্ততার দ্বা›িদ্বক সম্পর্ক তৈরি করে তিনি কবিতা রচনা করেন। বস্তুপৃথিবীর অনেক কিছুই খুব সহজেই তাঁর কবিতায় নির্বস্তুক হয়ে যায়, হয়ে যায় মানবায়িত। তবে বিস্ময়কর হচ্ছে, তিনি এভাবে কবিতা লেখেন খুব সহজ অনিবার্য শব্দ দিয়ে। কিন্তু কবিতাকে গভীর করে তোলেন ইমেজ বা প্রতিমার সাহায্যে। বাইরের পৃথিবী তাঁর কবিতায় এভাবেই রূপান্তরিত হয়ে যায় মনোজগতে, অথবা বলা যায় বস্তুপৃথিবীর সাহায্যে তিনি নির্মাণ করেন মনোজগৎ। তাঁর কবিতা তখনই হয়ে যায় আধুনিক। আধুনিক পৃথিবী ফ্রয়েড আর লাকাঁর প্রভাবে যেমন একদিকে অবচেতনাকে প্রাধান্য দিয়েছে, তেমনি ভাষাকেও। মনোবিজ্ঞানজীবী ট্রান্সট্রোমার এই ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই রচনা করেছেন কবিতা। তাঁর কবিতা এভাবেই অন্তিমে হয়ে উঠেছে মনোবিশ্লেষণধর্মী কবিতা। আধুনিক মানুষ আসলে উভমুখী; একদিকে সে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অংশ, অন্যদিকে সমাজের সঙ্গে সংলগ্ন। নিজেকে মানুষ যেমন উপলব্ধি করবে, তেমনি অনুভব করবে অন্যকেও; অন্য মানুষের প্রতি মানুষ সমান দায়বদ্ধ। কবিতায় প্রায় তিন দশক ধরে এই কাজটাই তিনি করে গেছেন বলে উল্লেখ করেছেন এক সাক্ষাৎকারে এবং বিভিন্ন কবিতায়।

এই সচেতনতাই, বলা বাহুল্য, পরিপার্শ্ব সম্পর্কে তাঁকে সংবেদনশীল করে তুলেছে। তিনি জন্মেছেন এক নাবিক পরিবারে, সমুদ্র তাই তাঁর অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। এই সমুদ্র বা সমুদ্রের প্রতিবেশেই তিনি রচনা করেছেন তাঁর বেশির ভাগ কবিতা। তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে তাঁর কবিতায় বৈচিত্র্য নেই। মানবীয় সব ঐতিহ্য ও অর্জন-বাড়িঘর, গ্রন্থ, জীবন-ইতিহাস, শিল্পনিদর্শন, এমনকি কবরস্থান সম্পর্কেও তিনি তীব্রভাবে সচেতন। বিশ্বনাগরিক হওয়া সত্তে¡ও তাঁর জীবনভাবনা ও অভিজ্ঞান সুইডিশ ঐতিহ্যেই শিকড়িত হয়ে আছে। পরাবাস্তববাদ আর আত্মজৈবনিক বাস্তবতার মিশেলে নির্মিত তাঁর কবিতা।

ট্রান্সট্রোমারের কবিতা এভাবেই হয়ে উঠেছে তীব্রভাবে মানবিক। মাড়িয়ে চলা যায় যে ঘাস, তৃণগুল্ম, ছুঁয়ে দেওয়া যায় যে গাছ, শহর ছাড়িয়ে যে ঘন বন ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ে, যেখানে নিস্তব্ধতারও ভাষা আছে। অথবা দ্বীপময় যে সমুদ্র, যেখানে আকাশ আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার, চিরচেনা অথচ রহস্যময় এই পৃথিবীকেই চমৎকারভাবে মূর্ত করে তুলেছেন তিনি। তাঁর বর্ণনার রীতি বা ন্যারেটিভের ধরনটা তাঁর একান্ত নিজস্ব। চারপাশের চেনা পৃথিবী তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে ঠিকই, তবে মগ্নচৈতন্যের গভীর তল থেকে উঠে এসেছে বলা কথাগুলো। বস্তুপৃথিবী সম্পর্কে একদিকে মরমিমুগ্ধতা, অন্যদিকে পরাবাস্তবতার পরিকীর্ণ মনোজগৎ-এই দুইয়ের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতাবিশ্ব। বাংলা কবিতার সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে জীবনানন্দ দাশের কথাই মনে পড়বে আমাদের। এই হচ্ছে মূলত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ট্রান্সট্রোমারের কবিতাবিশ্ব। সুইডেনের এক মহান কবি তিনি।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *