বাংলাদেশের মুগ্ধতায় বিদেশিনীর অর্ধ শতাব্দী পার

বাংলাদেশের মুগ্ধতায় বিদেশিনীর অর্ধ শতাব্দী পার

নারী ডেস্ক: লিকলিকে গড়ন। ফর্সা মানুষ। শরীরের চামড়ায় বয়সের ভাঁজ। তবে বয়স তার উদ্যমে বাধা হতে পারেনি। ভাঙা বাংলায় কথা বলেন। তিনি বলেন, মানুষ জিজ্ঞাসা করে- টোমার বিয়ে হয়েছে? আমি বলি- হয়েছে। কার সঙ্গে? সিআরপির (সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড) সঙ্গে! তারপর অদ্ভুত পবিত্র শব্দ তুলে হাসেন। এই হাসি তৃপ্তির হাসি। এ হাসি সেবায় সুস্থ মানুষের আনন্দের প্রতিচ্ছবি। হাসির দ্যুতি চারপাশের বাতাসে ভাসতে থাকে। হাসতে হাসতে তাঁর চোখের কোণে অশ্রু জমে। তিনি টিস্যু দিয়ে মোছেন। তিনি ভ্যালোরি টেইলর। ৮০ বছর বয়স পেরিয়েও তরুণী। সেবা নিয়ে এগিয়ে যেতে চান বহুদূর। তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ৯ ডিসেম্বর উদযাপন করেছে প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছর। সিআরপির স্বপ্নদ্রষ্টা সিস্টার ভ্যালোরি টেইলরের সঙ্গে সাভার সিআরপির বাসায় কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। সঙ্গে আছে উপকারভোগী মানুষের কথাও।


সিআরপিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৪ বছর আগে একটি শিশুকে ফার্মগেট ব্রিজের নিচে ফেলে যায় কেউ একজন। সে ছিল বিশেষায়িত শিশু। সেখান থেকে ফার্মগেটে অবস্থিত চ্যারিটেবল মিশন নামের এক প্রতিষ্ঠান তাকে তাদের হেফাজতে নেয়। সিআরপির বিশেষায়িত স্কুলে নিয়ে আসা হয়। বিশেষায়িত অনাথ এই শিশুটি সিআরপির সার্বিক তত্ত¡াবধানে বেড়ে উঠতে থাকে। বর্তমানে সিআরপি তার চলাচলের উপযোগী হুইল চেয়ার, বাসস্থান, কর্মসংস্থান ও জীবনসঙ্গীর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হয়তো বিশেষায়িত শিশু দেখে পরিবার ফেলে গেছে। তার বর্তমান নাম প্রদীপ। এ রকম হাজারো মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছে সিআরপি।


সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালোরি টেইলর। তাঁর সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৬৭ সাল লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতাল থেকে ফিজিওথেরাপির ওপর পড়াশোনা করেন ভ্যালোরি টেইলর। ইচ্ছা মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। মাত্র ১৫ মাসের জন্য অভিজ্ঞতা নিতে এসেছিলেন চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায়। চন্দ্রঘোনার খ্রিস্টান হাসপাতালের জন্য একজন ফিজিওথেরাপিস্টের দরকার হলে ডাক পড়ে টেইলরের।


তিনি বলেন, আমি ভাবছিলাম- মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান আমার ভালো লাগবে না। ভাবলাম যখন আমি ১৫ মাসের জন্য যেতে পারব তাহলে কেন দুই বছরের জন্য চুক্তি করব? সুতরাং আমি ১৫ মাসের জন্যই চুক্তি করেছিলাম। চন্দ্রঘোনার সৌন্দর্য অবাক করলেও কষ্ট পেতে থাকি, যখন দেখি ওই হাসপাতালে একটি হুইলচেয়ারও নেই। অথচ তাঁকে পঙ্গুদের চিকিৎসা করতে হয়। তিনি বড় হয়েছেন ইংল্যান্ডের আলসবেরিতে; যেখানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনজুরি সেন্টারটি অবস্থিত। ভ্যালোরি টেইলর বলেন, তিনি বাংলাদেশকে ভালোবেসে এখানে রয়ে গেছেন। তাঁর বাংলাদেশে অবস্থানের বয়স বাংলাদেশের মোট বয়সেরও চেয়েও বেশি। তিনি মুগ্ধ এই দেশের মানুষের আতিথেয়তায়। তিনি মাছ মাংস তেমন খান না। সবজি আর ফল তার প্রিয় খাবার। কাঁঠাল তাঁর খুব পছন্দের ফল। তিনি বলেন, ছোটবেলায় আমি দেখেছি, ইংল্যান্ডের আলসবেরিতে লোকজন স্পোর্টস সেন্টারে খেলাধুলা করছে। হুইলচেয়ারে আশপাশে ঘুরছে। কিন্তু চন্দ্রঘোনায় আমি কোনো হুইলচেয়ার দেখিনি।


১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে এই হাসপাতালের দুটি পরিত্যক্ত গুদামঘরে তিন-চারজন রোগী নিয়ে শুরু করেন সিআরপি। ১৯৯০ সালে ঢাকার কাছে সাভারে পাঁচ একর জায়গা কিনে সিআরপির স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলেন টেইলর। যেটি এখন ১০০ বেডের হাসপাতাল। এখানে ১০০ জন স্পাইনাল ইনজুরি রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। এ ছাড়া দেশের পাঁচটি বিভাগে ১৩টি শাখা রয়েছে সিআরপির। বছরে প্রায় ৮০ হাজার রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। বর্তমানে সিআরপিতে ১ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করছেন। তাদের অনেকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসে পুনর্বাসিত হয়েছেন।


সূত্র জানায়, পঙ্গু মানুষদের পুনর্বাসনে অবদানের জন্য ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পদক পান টেইলর। এর আগে ১৯৯৮ সালে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশের দাতাগোষ্ঠী ও সংস্থার অনুদানে পরিচালনা করা হয় সিআরপির কার্যক্রম। যারা সিআরপিতে বিভিন্ন সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন, পরে তারাই এটিকে পরিচালনার জন্য অর্থের জোগান দিতে থাকেন।


ব্যক্তিগত জীবনে ভ্যালোরি টেইলর বিয়ে করেননি। দুজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত মেয়েকে দত্তক নেন। তাদেরকে কাজ শেখান। এদের মধ্যে একজনকে সিআরপিতে চাকরির ব্যবস্থা করেন। অন্যজনের শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় চাকরি করতে পারেননি। সেই মেয়েটি টেইলরের সঙ্গে থাকেন।


কুমিল্লার বাসিন্দা সিআরপির সেবা নেওয়া রফিকুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘২০১৪ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল কর্ড ইনজুরড হওয়ায় শারীরিক চলনক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। পরে সিআরপিতে চিকিৎসা গ্রহণ করি। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হুইল চেয়ারে বসেই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করি। সিআরপি আমাকে শিখিয়েছে জীবনের জটিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে কীভাবে মানিয়ে নিতে হবে ও মূলধারার মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে।’ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক রায়হান মিঠু বলেন, ‘আমরা বাধাহীন একটা বাংলাদেশ চাই। আমরা আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের অধিকারের কথা বলি। হতাশ না হয়ে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র আমরা সিআরপিতে পেয়েছি।’

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *