স্বামী বিবেকানন্দ: মানবতাবাদী দার্শনিক

স্বামী বিবেকানন্দ: মানবতাবাদী দার্শনিক


মোহাম্মদ দিদারুল আলম
১৮৯৭ সালের ১লা মে রামকৃষ্ণ মিশনের যাত্রা শুরু হয় কলকাতায় বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকায়ও প্রতিষ্ঠিত হয় রামকৃষ্ণ মিশন। মানবসেবার বহুমুখী দরজা খোলা রেখে স্বামী বিবেকানন্দ মানবতাবাদী কর্মের ইতিহাসে যে অনন্য নজির স্থাপন করেন, তার ফলশ্র“তিতে ভারতের সর্বত্র রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার সংখ্যা ৮৩টি। ভারতের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১১টি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ৪১টি মঠ, ৫০টি মিশন ও ২১টি যুক্ত মঠ-মিশন মানব কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষকে ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই স্বামী বিবেকানন্দ কাজ করে গেছেন আজীবন। তাঁর জীবনদর্শন ছিল পৃথিবীর সকল মানুষের, সকল সমাজের, সকল শ্রেণির সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, যার ফলে মানুষ হয়ে উঠবে যথার্থ মানুষ, আলোকিত মানুষ, শ্রেষ্ঠ মানুষ। বিলে ওরফে নরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম হয় কলকাতায় ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণের পরে তিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিতি লাভ করেন। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত পেশায় ছিলেন আইনজীবী। মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী গৃহিণী। পারিবারিক পরিবেশে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের পর নরেন্দ্রনাথ দত্তকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি এ স্কুলে ঠিকমত বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। দুই বছর বাবার কর্মস্থল মধ্যপ্রদেশের রায়পুরায় অবস্থান করে পারিবারিক পরিবেশে সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় ফিরে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঐ বছর ওই স্কুল থেকে একমাত্র নরেন্দ্রনাথই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এতে খুশি হয়ে তাঁর পিতা তাঁকে একটি রূপার ঘড়ি উপহার দেন। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে নরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পুনরায় অসুস্থতার কবলে পড়েন। উপস্থিতির হার কম থাকায় প্রেসিডেন্সি কলেজ তাঁকে এফ এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি না দেওয়ায় তিনি জেনারেল এসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে পাস করেন। অতঃপর একই কলেজ থেকে ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাস করেন। এ সময় তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। কিছুকাল তিনি মেট্রোপলিটন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। যতদূর জানা যায়, ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে নরেন্দ্রনাথদের পাড়ায় সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের (১৮৩৬-১৮৮৬) আগমন ঘটে। সেখানে এক সংগীতসভায় ভজন গাইলে নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের নজরে পড়েন। ধর্মীয়সংগীত ও ধর্মশিক্ষায় নরেন্দ্রনাথ ছিলেন অতিশয় মেধাবী ও বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। গানের অনুষ্ঠানে পরিচয়ের পর থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে নরেন্দ্রনাথের জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রভাব বাড়তেই থাকে। অবশেষে মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে শ্রীরামকৃষ্ণ অপর কয়েকজন কিশোর ভক্তসহ নরেন্দ্রকে সন্ন্যাসমন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে যান। গুরুর মৃত্যুর পর নরেন্দ্রনাথ সংসারধর্ম ত্যাগ করে রামকৃষ্ণ মঠে আশ্রয় নেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে তিনি ভক্ত-শিষ্যদের মধ্যে সন্ন্যাসী বিবিদিশানন্দ/স্বামীজী প্রভৃতি অভিধায় ভ‚ষিত হতে থাকেন। অতঃপর ১৮৯১-এর দিকে খেতরির মহারাজ অজিত সিং নরেন্দ্রনাথকে স্বামী বিবেকানন্দ নামে ভূষিত করেন। সন্ন্যাসী হিসেবে তিনি তিন বছরাধিককাল সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন। অতঃপর ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগোতে বিশ্ব ধর্মসভায় সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে অসামান্য কৃতিত্ব লাভ করেন। স্বামী বিবেকানন্দ রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে সঙ্গীত কল্পতরু (১৮৮৭), Karmayoga (১৮৯৬), Rajayoga (১৮৯৯), Vedanta Philosophy: An Address Before The Graduate Philosophical Society (১৮৯৬), Lectures From Colombo to Almora (১৮৯৭), বর্তমান ভারত (১৮৯৯),My Master (১৯০১), Vedanta Philosophy: Lectures on Jnanayoga (১৯০২), পরিব্রাজক (১৯০৩), ভাববার কথা (১৯০৫) ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরেও তাঁর অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়।
স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন
নরেন্দ্রনাথ যে সময়টিতে বেড়ে ওঠেন তখন উপমহাদেশের মানুষ একদিকে ছিল দারিদ্র্যপীড়িত, অপরদিকে পরাধীনতা, আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, নীতিহীনতা, সামাজিক ভণ্ডামী ও শঠতায় নিমজ্জিত ছিল ভারতীয় সমাজ। রামমোহন, রাধাকান্ত, দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র, অক্ষয়কুমার, বিদ্যাসাগর প্রমুখের পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, দর্শন ও যুক্তিনির্ভর ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের একশো বছরের প্রচেষ্টা যখন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্য ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে, ঠিক তখনই নরেন্দ্রনাথ গ্রহণ করলেন ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে স্বামী বিবেকানন্দ যুক্তি, দর্শন ও বিজ্ঞানকে প্রেমের আবরণে মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতে, ছড়িয়ে দিতে, অপার প্রেমের আলোয় ভারতজনকে আলোকিত করতে উদ্বুদ্ধ হলেন। তাঁর দর্শনের সৌধ বিনির্মিত হয় জ্ঞান ও প্রেমের যৌথভিত্তির উপর। বিবেকানন্দের দর্শনে অধিবিদ্যিক ভাবনাটি সম্পূর্ণরূপে বেদান্তদর্শনের ওপর ভিত্তি করে রচিত। বেদান্তদর্শন অনুযায়ী ‘ব্রহ্ম’ই মূল বা চরম সত্য। জগৎ মায়া বা মায়ার সৃষ্টি। জগতের মত জীবও ব্রহ্মেরই অংশ। তাই ব্রহ্মের মধ্যে লীনতাই জীবের মুক্তি। বেদান্ত দার্শনিক শংকরাচার্যের মায়াবাদকে তিনি যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলেন। এসময় তিনি গৌতমবুদ্ধের মানবতাবাদেও প্রভাবিত হন। এজন্য বলা হয়ে থাকে, বিবেকানন্দের ওপর শংকরাচার্যের প্রভাব ছিল মূলত তাত্তি¡ক এবং গৌতমবুদ্ধের প্রভাব ছিল প্রধানত ব্যবহারিক। বিবেকানন্দ মনে করতেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির ধারা নিয়তই প্রবহমান। তার আদি বা অন্ত নেই। পশ্চাতে আছে তিনটি সত্তা, প্রথমটি হল অসীম ও পরিবর্তনশীল প্রকৃতি। দ্বিতীয়ত আছেন ঈশ্বর, অপরিবর্তনীয় ও শান্ত। তৃতীয়ত আছে আত্মা যা ঈশ্বরের মতই অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত। ঈশ্বরই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কার্যকারণ ও উপাদান। স্বামী বিবেকানন্দের মতে বিশ্বব্র্হ্মাণ্ডের সকল কিছুরই উৎপত্তি হয়েছে আদি উপাদান আকাশ হতে। জগতের সকল শক্তি তথা বস্তুর অবিনাশিতার শক্তি, বস্তুর শক্তি কিংবা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অথবা জগতের প্রাণশক্তি যাই হোক না কেন, তা আদিশক্তি প্রাণক্রিয়ার পরিণতি। এই পরিণতি-প্রক্রিয়া চলমান থাকে চক্রাকারে। এই চক্রের শুরুতে আকাশ নিশ্চল ও অব্যক্ত থাকে, তারপর শুরু হয় প্রাণের লীলা, সৃষ্টি করে গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ, নক্ষত্র, তারকা তথা বিশ্বজগত বা প্রকৃতি। লক্ষ-কোটি বছর ধরে নিরন্তর বিবর্তনের ফলে এই বিবর্তন প্রক্রিয়া বিবর্তনের শীর্ষে অবস্থান করার পর শুরু হয় পুনর্বার নেতিবাচক বিবর্তন বা অবরোহণ প্রক্রিয়া। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই নিয়মের রাজত্ব বিদ্যমান। সবকিছুই একটি সুশৃঙ্খল নিয়মের অধীনে চলছে। এই সার্বিক নিয়মের ক্রিয়াপরতা দেহ, মন ও আত্মাÑ সবকিছুকে প্রভাবিত করে। এই নিয়মই মানুষকে সার্বিক নিয়ম বা প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে একটি আকারগত সত্য উপলব্ধিতে সহায়তা করে। দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের পর মানুষ অনুভব করে যে, কোন বিশেষ অবস্থায় অতীতে যা যা ঘটেছে, ভবিষ্যতে অনুরূপ অবস্থায় তা-ই তা-ই ঘটবে। এইভাবেই মানুষ অনুধাবন করে যে, প্রকৃতি সমরূপ, ঐক্যপন্থী, পুনরাবৃত্তিমূলক, বিবর্তনশীল ধারার বাহক। জগৎ এক না বহু? দৃশ্যমান জগতের নানা রূপ বা ভেদ বিদ্যমান। বিবেকানন্দের মতে, এই ভেদজ্ঞানই মানুষের যত দুঃখ-যন্ত্রণার কারণ। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, আমাদের চারপাশে যে বহুকে দেখছি, অনুভব করছি, বহুকে নিয়েই বসবাস করছি তা কি মিথ্যাÑ অলীক? এই প্রশ্নের উত্তরে বৈদান্তিকেরা বলেন, ‘এই যে নানা/ বহুকে আমরা দেখছি তা একেরই প্রকাশ’, অর্থাৎ এসবই হল সেই ব্রহ্ম-স্বরূপ, সেই বৃহতেরই বিচিত্র প্রকাশ। উপনিষদে যে মৌলিক একত্বের কথা বলা হয়েছে, এটিই ভারতে শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রাক্তন ছাত্রদের প্রতি আবেদন বিবেকানন্দের কর্মবাদ অনুসারে প্রতিটি কর্মের ফল রয়েছে। কর্ম অবশ্যই কোন না কোন ফল উৎপাদন করবে। আগে হোক বা পরে হোক প্রতিটি কর্মেরই ফল অবশ্যম্ভাবী। কতকগুলি অবশ্যম্ভাবী ফল উৎপাদন না করে কোন কর্মই ধ্বংস হতে পারে না। এই কর্মফল ভোগ করার জন্যই মানুষকে জন্ম-জন্মান্তর জন্মচক্রের অবর্তে জন্মগ্রহণ করতে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মার মোক্ষ লাভ হয়। ০৬ জানুয়ারি ২০১৪ শংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদ, যেখানে জগতের নানাত্ব, বহুত্ব ব্যাখ্যাত হয়েছে ‘মায়া’-র ধারণা দ্বারা। বিবেকানন্দ শংকরের অদ্বৈতবাদের মায়াকে ভিন্ন আঙ্গিকে গ্রহণ করেন। তাঁর মতে, মায়া জগৎ-সংসার কে অলীক বা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয় না। তিনি বললেন, ‘সংসারে ঘটনা যেইভাবে বর্তমান রহিয়াছে মায়া তাহারই বর্ণনা মাত্র’ অর্থাৎ ঝঃধঃবসবহঃ ড়ভ ভধপঃ, ফবহরধষ ড়ভ ভধপঃ নয়। মায়া অনির্বচনীয় কেন-না, ‘একমাত্র চরম সত্যকে সৎ বলা যেতে পারে। সেদিক দিয়ে দেখলে অসৎ মায়ার অস্তিত্ব নেই। কাজেই মায়া অসৎ একথা বলা যায় না। কারণ যদি তা হতে হয় তবে মায়া কখনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সৃষ্টি করতে পারত না। কাজেই ইহা এমন এক বিষয় যাহা সৎও নয় আবার অসৎও নয়। এজন্য মায়া অনির্বচনীয় বা বাক্য দ্বারা প্রকাশ্য নয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।’ বিবেকানন্দ মায়াকে ব্রহ্মেরই একটি সক্রিয় শক্তি বলে গ্রহণ করেছেন। এ শক্তিরই ক্রিয়ার ফলে এ বিশ্বের সব কিছুর উৎপত্তি হয়েছে। বিবেকানন্দের কাছে মায়া শুধুমাত্র একটি মতবাদ নয়, এটি সত্যের প্রকাশ। শুধুমাত্র মায়ার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, তিনি মায়ার প্রেক্ষিতে জগৎ ও জীবনকেও ব্যাখ্যার প্রয়াস পান। শংকরীয় ‘মায়া’-দর্শনের বিরুদ্ধে যে প্রশ্ন উঠেছে, মায়া তিরোহিত হলে জীবজগতের অস্তিত্ব কোথায়? এত মায়াতেই সৃষ্টি। এ-প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ‘জীবাত্মাই নির্বিশেষ ব্রহ্ম, প্রকৃতির ভিতর যাহাই সৎবস্তু তাহাই ব্রহ্ম।’ বেদান্তদর্শনের মূলস্্েরাতের সঙ্গে সহমত হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উপাদান দিয়েই মানুষের জৈবগঠন সম্পন্ন হয়েছে। মানুষ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সংশ্লেষিত রূপ বা অণুবিশ্ব। তাঁর মতে, ধাতুর ভৌত পদার্থ, উদ্ভিদজগতের প্রাণশক্তি, জীবের জান্তববোধÑ যেমন ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং আত্মা মানুষকে যথার্থ মানুষে পরিণত করেছে। মানুষের প্রকৃত স্বরূপ হল তার আত্মা। এই আত্মার কোন ধ্বংস বা বিনাশ নেই। আত্মা অবিনশ্বর। মানুষ হচ্ছে প্রকৃতির একটি অংশ। প্রকৃতির বিবর্তন মানুষের বেলায়ও প্রযোজ্য, অর্থাৎ প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষ বিবর্তন নীতির অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বলেন, ‘বিভিন্ন জাতির ইতিহাস এমন যে, এদের উত্থান-পতন ঘটে। উত্থানের পরই একটি পতন আসে। পতন থেকে বৃহত্তর শক্তিতে আবার উত্থান ঘটে। এই উত্থান ও পতন সবসময়ই চলমান। ধর্মীয় জগতেও এই একই গতি অস্তিত্বশীল। প্রতিটি জাতির আধ্যাত্মিক জগতে যেমন পতন আছে, তেমনি উত্থানও আছে।’ অর্থাৎ মানুষকেও প্রকৃতি ও সমাজের বিবর্তনক্রিয়ার পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়েই প্রগতির পথে ধাবিত হতে হয়। আত্মার ধারণা, প্রকৃতি, দেহ-আত্মার সম্পর্ক ইত্যাদি প্রশ্নে বিবেকানন্দের দর্শন উপনিষদজাত তথা বেদনির্ভর (উপনিষদ হচ্ছে বেদের ব্যাখ্যা)। আত্মা সম্পর্কে ভারতীয় দার্শনিকদের গতানুগতিক বক্তব্য হচ্ছে আত্মা মন নয়, কারণ মনের পরিবর্তন আছে, এই ক্ষণে মন একরকম ধারণা করে, পরক্ষণেই তা পরিবর্তিত হয়। মনের অস্থিরতা নামক বৈশিষ্ট্যের কারণেই ‘অস্থির মতি’ কথাটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আত্মা একটি স্থির, স্থায়ী, অপরিবর্তনশীল, নিত্য সত্তা হিসাবে পরিগণিত হয়। আত্মা প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বলেন, ‘যা কিছু আত্মা তা প্রকৃতিগতভাবে অবিমিশ্র পদার্থ। অন্য কোন উপাদান এর মধ্যে নেই, তাই এর মৃত্যু হতে পারে না। আত্মা প্রকৃতিগতভাবে অবিনাশী। আত্মা কোন পদার্থ থেকে সৃষ্ট হয়নি। ‘আত্মাকে তরবারি ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, জল আর্দ্র করিতে পারে না, বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না। সেই আত্মা এমনই এক বৃত্তস্বরূপ, যাহার পরিধি নির্ণয় করা যায় না। কিন্তু যাহার কেন্দ্র কোন একটি দেহের মধ্যে অবস্থিত এবং সেই কেন্দ্রের দেহ হইতে দেহান্তরে গমনের নামই মৃত্যু।’ বিবেকানন্দের কর্মবাদ অনুসারে প্রতিটি কর্মের ফল রয়েছে। কর্ম অবশ্যই কোন না কোন ফল উৎপাদন করবে। আগে হোক বা পরে হোক প্রতিটি কর্মেরই ফল অবশ্যম্ভাবী। কতকগুলো অবশ্যম্ভাবী ফল উৎপাদন না করে কোন কর্মই ধ্বংস হতে পারে না। এই কর্মফল ভোগ করার জন্যই মানুষকে জন্ম-জন্মান্তর জন্মচক্রের আবর্তে জন্মগ্রহণ করতে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মার মোক্ষ লাভ হয়। স্বাধীনতার প্রশ্নে বিবেকানন্দ বলেন, প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্তি অর্জনই মানুষের ঈপ্সিত লক্ষ্য। সে মুক্ত হলে প্রকৃতি তার বশীভূত হয়। বন্দিদশা থেকে আত্মার মুক্তি ও তার আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াসেরই নাম জীবন। এই প্রয়াসে যদি সাফল্য আসে, তাহলে তাকে বলা হবে বিবর্তন। দাসত্বের বন্ধনমুক্ত পরবর্তী জীবন হচ্ছে মুক্তি, নির্বাণ বা মোক্ষ। সুতরাং ‘প্রতিটি মানুষের পরম লক্ষ্য হচ্ছে ব্রহ্মের সঙ্গে একানুভূতি লাভ।’ উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই যে, জগৎ, জীবন এবং তার সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর তথা অদ্বৈত বেদান্তের ব্রহ্মদর্শন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিবেকানন্দ নিজেকে নতুন ধরনের দর্শনের প্রবর্তকরূপেও প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও মধ্যযুগীয় দর্শনের মত বিবেকানন্দের দর্শনও ধর্মনির্ভর, তবুও জগৎ ব্যাখ্যায়, মায়ার স্বরূপ বিশ্লেষণে তাঁর বিজ্ঞান মনষ্কতার পরিচয় মেলে। জীব, জগৎ ও মায়া দর্শনের মাধ্যমে ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের বর্ণনা করে তিনি এ জগতে মানবজাতির মর্যাদাকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছেন। এজন্য জগতে মানবতাবাদীদের মধ্যে তাঁকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক বলে গণ্য করা যায়।
চলবে

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *