বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়বে দেড় ডিগ্রি

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়বে দেড় ডিগ্রি


দেওয়ানবাগ ডেস্ক: অব্যাহত কার্বন নিঃসরণের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধির সহনীয় ১.৫ ডিগ্রির সীমা ধারণার চেয়েও আগে পেরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নিঃসরণ এত দিনের ধারণার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে এ সীমা ছাড়ানোর দিকে পরিচালিত করতে পারে। ‘নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’ জার্নালে প্রকাশিত এক নতুন গবেষণা প্রতিবেদনে উচ্চারিত হয়েছে এ সাবধান বাণী।
গবেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রত্যাশা ২০৩০-এর দশকের মাঝামাঝির বদলে বরং ২০২৯ সালের মধ্যেই ১.৫ ডিগ্রির সীমা পেরিয়ে যেতে পারে।
তাঁরা বলছেন, গত তিন বছরে রেকর্ড মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ এর একটি মূল কারণ। এক বছরের অভূতপূর্ব গরমের পর (রেকর্ড মতে গত জুলাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ মাস) এ বছরটির গড় তাপমাত্রা সামগ্রিকভাবে শিল্পায়নের যুগের আগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশির কাছাকাছি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ১৮৫০ সাল থেকে প্রথম শিল্পক্ষেত্রে কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
বিজ্ঞানীরা এটা ভেবে উদ্বিগ্ন যে শিগগিরই পৃথিবী এত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করবে যে তাপমাত্রা আরো অনেক দীর্ঘ সময় এই স্তরেই বহাল থেকে যাবে। ১.৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচিত ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক নেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রæতির একটি মূল দিক। নেতারা এতে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধিকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ‘যথেষ্ট নিচে’ রাখতে এবং এই শতকে ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। দেড় ডিগ্রির পরিসংখ্যানটি উন্নয়নশীল দেশ এবং ছোট দ্বীপদেশগুলোর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়।
নতুন গবেষণাটিতে ১.৫ ডিগ্রিতে পৌঁছতে বিশ্বের কত সময় লাগবে তা নির্ধারণ করার জন্য বিজ্ঞানীরা একটি হিসাব কষেছেন। তাতে দেখা হয় সীমাটি লঙ্ঘন করার আগে মোট কী পরিমাণ কার্বন নিঃসৃত হতে পারে।
এই বছরের শুরুর দিকে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রধান পরামর্শক সংস্থা আন্ত সরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) অনুমান ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে বিশ্ব আর মাত্র ৫০০ বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ করতে পারবে। আর উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখতে পারার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমান বার্ষিক নিঃসরণের মাত্রা প্রায় ৪০ বিলিয়ন টন বলে আইপিসিসির ধারণা ছিল, পরের দশকের মাঝামাঝি নাগাদই স্থায়ীভাবে এই সীমা পেরিয়ে যাবে। কিন্তু আলোচ্য নতুন বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এটি তার চেয়ে অনেক আগেই ঘটবে।
গবেষকরা দেখেন, আইপিসিসি মাত্র ২০২০ সাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত অন্তর্ভুক্ত করেছিল। তাই তাঁরা গত তিন বছরে নিঃসৃত বিপুল কার্বনের হিসাব মেলাতে ‘বাজেটের’ সমন্বয় করেছেন।
গবেষকরা উষ্ণায়নকে প্রভাবিত করে এমন অন্য অ-কার্বন কারণগুলোর ভূমিকাও আবার পরীক্ষা করে দেখেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর একটি হচ্ছে অ্যারোসল নামক কণা, যা প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে উৎপন্ন হয়। এ উপাদানগুলো বায়ুদূষণে ব্যাপক অবদান রাখলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি অপ্রত্যাশিত সুবিধা দেয়। কারণ এগুলো সূর্যের আলো আকাশে প্রতিফলিত করে বায়ুমণ্ডলকে শীতল রাখতে সহায়তা করে। নতুন গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, এই অ্যারোসলগুলো পৃথিবীর শীতলীকরণে আগের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে শহরগুলোর দূষিত বাতাস পরিচ্ছন্ন করা এবং সবচেয়ে বেশি দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর চেষ্টা চলায় বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসলের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, তাপমাত্রাও আগের ধারণার চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, অ্যারোসলগুলোর ভূমিকা বিষয়ে নতুন উপলব্ধির আলোকে দেড় ডিগ্রি সীমিত রাখার বাজেট থেকে ১০০ বিলিয়ন টন কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত কার্বন এবং অন্য কিছু ছোটখাটো সমন্বয় বিবেচনা করলে নিঃসরণ বাজেট ২৫০ বিলিয়ন টনে নেমে আসে। অর্থাৎ উষ্ণতাবৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে হলে আইপিসিসির হিসাবমতো ৫০০ বিলিয়ন নয়, আর মাত্র ২৫০ বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণের সুযোগ রয়েছে পৃথিবীর।
গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের রবিন ল্যাম্বল বলেছেন, ‘১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে, কারণ আমরা নিঃসরণ অব্যাহত রেখেছি। আমরা এখন অনুমান করছি, বর্তমান নিঃসরণ হারে প্যারিস চুক্তির রেফারেন্স পয়েন্ট অতিক্রম করার আর বছর ছয়েক বাকি আছে। ’
এই গবেষকদলের মতে, ১.৫ ডিগ্রির ওপরে যাওয়া এড়াতে হলে কার্বন ডাই অক্সাইডের বৈশ্বিক নিঃসরণ ২০৩৪ সালের মধ্যেই ‘নেট জিরো’তে পৌঁছতে হবে, বর্তমানের প্রত্যাশামতো ২০২৫ সালের মধ্যে নয়। যে পরিমাণ কার্বন নিঃসৃত হচ্ছে, সে পরিমাণই বায়ুমণ্ডল থেকে বিভিন্ন উন্নত প্রক্রিয়ায় সরিয়ে নেওয়া গেলে তা হবে ‘নেট জিরো’ পরিস্থিতি।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক জোরি রোজেল বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে বর্তমান বৈজ্ঞানিক লেখালেখিতে এমন কোনো সামাজিক-প্রযুক্তিগত পরিস্থিতির কথা নেই, যাতে বলা হয়েছে এটি করা সম্ভব। এমনকি এটি কিভাবে সম্ভব হতে পারে তা-ও বর্ণনা করেননি কেউ।’
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুবাইয়ে কপ২৮ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা মিলিত হতে যাচ্ছেন। এই নতুন বিশ্লেষণটি নিঃসরণের বিষয়ে আরো চরম পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *