মক্কার তাবারি পরিবারের জ্ঞানপ্রদীপ: আয়েশা বিনতে আবদুল্লাহ (রহ.)

মক্কার তাবারি পরিবারের জ্ঞানপ্রদীপ: আয়েশা বিনতে আবদুল্লাহ (রহ.)

আলেমা হাবিবা আক্তার: আয়েশা বিনতে আবদুল্লাহ বিন আহমদ (রহ.) ছিলেন ইমাম মুহিবুদ্দিন আহমদ আত-তাবারি (রহ.)-এর নাতি ও তাবারি পরিবারের উজ্জ্বল জ্ঞানপ্রদীপ। যিনি হাদিস, ফিকহ, সিরাত ও ইতিহাস চর্চায় দাদা মুহিবুদ্দিন তাবারি (রহ.)-এর মতোই অগ্রগামী ছিলেন। ইমাম মুহিবুদ্দিন তাবারি (রহ.) ছিলেন মক্কার বিচারক ও শাফেয়ি মাজহাবের বিশিষ্ট ইমাম। ফিকহশাস্ত্রে তাঁর উচ্চতর দক্ষতা ও পাণ্ডিত্যের কারণে ‘ফকিহুল হারাম’ (মক্কার শ্রেষ্ঠ আইনবিদ) ও ‘মুহাদ্দিসুল হিজাজ’ (আরব উপদ্বীপের শ্রেষ্ঠ হাদিসবিশারদ) উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। জ্ঞানচর্চায় আয়েশা (রহ.) ছিলেন দাদার প্রতিচ্ছবি।
আয়েশা (রহ.)-এর বংশধারা হুসাইন বিন আলী (রা.)-এর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছে। তারা মক্কার অধিবাসী হওয়ার পরও তাদেরকে তাবারি বলার কারণ হলো তাঁর ঊর্ধ্বতন দাদা মুসা বিন ইবরাহিম (রহ.) রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাবার বা তাবারিস্তানে (আধুনিক ইরান ও তুর্কমিনিস্তানের সীমান্তবর্তী প্রাচীন রাষ্ট্র) পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানে তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন বসবাস করেন।
আয়েশা (রহ.)-এর দাদার বাবা আবু বকর রাদিউদ্দিন বিন আলী (রহ.) তাবার থেকে মক্কায় ফিরে আসেন এবং মক্কায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আয়েশা বিনতে আবদুল্লাহ (রহ.)-এর পরিবার ছিল ধর্মীয় জ্ঞান ও নেতৃত্বে মক্কার ঐতিহ্যবাহী পরিবার। যেমন তাঁর দাদা মুহিবুদ্দিন তাবারি (রহ.) ছিলেন মসজিদুল হারামের ইমাম, হেরেমের খতিব ও মক্কার বিচারক। তাঁর চাচা জামালুদ্দিন তাবারি (রহ.) ছিলেন মক্কার বিচারক এবং তাঁর বাবা আবদুল্লাহ (রহ.) ছিলেন পবিত্র হেরেমের খতিব।
যাঁকে ‘খাতিবুত তুকা’ (আল্লাহভীরুদের উপদেশ দানকারী) উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ইমাম হামাভি (রহ.) লেখেন, ‘তাবারিরা ছিলেন জ্ঞান ও সম্মানের অধিকারী একটি পরিবার। যাঁরা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত (সমগ্র পৃথিবীতে) খ্যাতি লাভ করেছিলেন। মক্কার অভিজাত পরিবারগুলোর ভেতর সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন তাঁরা।’
পারিবারিক পরিমণ্ডলেই আয়েশা বিনতে আবদুল্লাহ (রহ.)-এর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল এবং নিজের বাবা, চাচা ও ভাইদের কাছ থেকেই তিনি ধর্মীয় জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পাঠ গ্রহণ করেন।
যেমন তিনি দাদা ইমাম মুহিব্বুদ্দিন আহমদ তাবারি (রহ.) ও চাচা জামালুদ্দিন তাবারি (রহ.)-এর কাছ থেকে হাদিসের পাঠ গ্রহণ করেন। অবশ্য মুহাদ্দিস ফখরুদ্দিন নুওয়াইরি (রহ.)-সহ একাধিক মুহাদ্দিসের কাছ থেকেও তিনি হাদিসের সনদ ও অনুমতি লাভ করেন। মুহাদ্দিস আবু হামেদ বিন জুহাইরা (রহ.) আয়েশা বিন আবদুল্লাহ (রহ.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইতিহাসশাস্ত্রে তাঁর শিক্ষক ছিলেন দাদা মুহিবুদ্দিন, পিতা আবদুল্লাহ, চাচা জামালুদ্দিন ও ভাই আহমদ (রহ.) প্রমুখ। ঐতিহাসিক রাদি বিন খলিলের কাছ থেকেও তিনি ইতিহাসের পাঠগ্রহণ করেন। তাঁর থেকে ইতিহাস বর্ণনা করেছেন কাজি মুহিবুদ্দিন নুওয়াইরি ও শামের বিশিষ্ট ফকিহ ও মুফতি শিহাবুদ্দিন আহমদ (রহ.) প্রমুখ।
ব্যক্তিগত জীবনে আয়েশা বিনতে আবদুল্লাহ (রহ.) দুইবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথমে তিনি শায়খ ইউসুফ বিন আহমদ (রহ.)-কে বিয়ে করেন। এ সংসারে আহমদ ও মারিয়াম নামে দুই সন্তানের জন্ম হয়। দ্বিতীয়বার আবদুল্লাহ বিন যাইন তাবারি (রহ.)-কে বিয়ে করেন। এই সংসারে জয়নব ও ফাতেমা নামে দুই কন্যার জন্ম হয়। ছেলে আহমদের সম্মানে তাঁকে ‘উম্মুল হুদা’ (পথপ্রদর্শকের মা) উপাধি দেওয়া হয়।
ইমাম সাখাভি (রহ.) আয়েশা বিনতে আবদুল্লাহ (রহ.)-কে একজন লেখিকা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যিনি নিজ বংশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মনীষীদের ওপর ‘তারিখে বনি তাবারি’ নামক মূল্যবান গ্রন্থটি রচনা করেন। যাতে পারিবারিক বর্ণনার পাশাপাশি সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হয়েছে।
বরেণ্য এই নারী মনীষীর জন্ম ও মৃত্যু সন সম্পর্কে সঠিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, তিনি ৭৬১ হিজরির পর মারা যান। কেননা ৭৬১ হিজরিতে শায়খ শিহাবুদ্দিন আহমদ (রহ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *