রবীন্দ্রনাথের আত্মবিশ্বাস ও উপলব্ধি

রবীন্দ্রনাথের আত্মবিশ্বাস ও উপলব্ধি

সুভাষ সিংহ রায়: রবীন্দ্রজীবনচরিত গভীরভাবে অনুশীলন করলে তার থেকে আমরা এমন কিছু শিক্ষা পেতে পারি, যা আমাদের বেঁচে থাকার পথকে আলোকিত করে তোলে। সুখে, দুঃখে আনন্দ-উৎসবে, এমনকি নিদারুণ ধ্বংসলীলার মধ্যেও তাঁর গান, তাঁর কবিতা মানুষের হৃদয়জুড়ে আছে এবং থাকবেও। এ কথা গভীর আত্মবিশ্বাসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উপলব্ধি করেছিলেন।
পৃথিবীর অন্যতম যুদ্ধবিরোধী কবি উইলফ্রেড ওয়েনকে (১৮ মার্চ ১৮৯৩ – ৪ নভেম্বর ১৯১৮) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (২৮ জুলাই ১৯১৪ – ১১ নভেম্বর ১৯১৮) রণাঙ্গনে যেতে হয়েছিল বাধ্য হয়েই। অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা এই যে মাত্র ২৫ বছর বয়সে যুদ্ধ সমাপ্তির সাত দিন আগে তিনি নিহত হয়েছিলেন। যুদ্ধে নিহত সেই মহান ইংরেজ কবির পকেটে পাওয়া গিয়েছিল একটি ডায়েরি, লেখা ছিল ১৯১২ সালে প্রকাশিত ‘Gitanjali – Song Offerings’-এর ৯৬ সংখ্যক কবিতাটি, ‘When I go from hence/Let this be my parting work/That what I have seen is unsurpassable’…নিচে লেখা Rabindranath Tagore
(অর্থাৎ ১৯১০ সালের ১৪ আগস্ট বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’র…১৫৭ সংখ্যক কবিতা ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই/যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’) উইলফ্রেড ওয়েনের মা সুজান এইচ ওয়েন জানতেন তাঁর ছেলের রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধার কথা। তিনি রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, রথীন্দ্রনাথ-কৃত সেই চিঠির বাংলা তর্জমা লিপিবদ্ধ হয়েছে তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে।
‘শ্রজবেরি
১ আগস্ট ১৯২০
শ্রদ্ধেয় স্যার রবীন্দ্রনাথ,
যেদিন শুনেছি আপনি লন্ডনে এসেছেন, সেদিন থেকে রোজই ভাবছি আপনাকে চিঠি লিখি। আর আপনাকে আমার মনের কথাটুকু জানানোর জন্য সেই চিঠি লিখছি। এই চিঠি আপনার হাতে গিয়ে পৌঁছবে কি না জানি না; কারণ আপনার ঠিকানা আমার জানা নেই। তবু আমার মনে হচ্ছে, লেফাফার ওপর আপনার নামটুকুই যথেষ্ট। আজ থেকে দুই বছর আগে আমার অতি স্নেহের বড় ছেলে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ফ্রান্স পাড়ি দিল। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। যাওয়ার আগে আমার কাছে বিদায় নিতে এলো। আমরা দুজনই তাকিয়ে আছি ফ্রান্সের দিকে। মাঝখানে সমুদ্রের জল রৌদ্রে যেন ঝলমল করছে। আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় আমাদের বুক ভেঙে যাচ্ছে। আমার কবি-ছেলে তখন আপনমনে আপনার লেখা কবিতার সেই আশ্চর্য ছত্রগুলো আওড়ে চলেছে-
যাবার দিনে এই কথাটি
বলে যেন যাই-
যা দেখেছি, যা পেয়েছি
তুলনা তার নাই।…
তার পকেট-বই যখন আমার কাছে ফিরে এলো, দেখি তার নিজের হাতে এই কয়টি কথা লিখে তার নিচে আপনার নাম লিখে রেখেছে। যদি কিছু মনে না করেন, আমায় কি জানাবেন কোন বইয়ে সম্পূর্ণ কবিতাটি পাওয়া যাবে?
এই পোড়া যুদ্ধ থামার এক সপ্তাহ আগে আমার বক্ষের ধন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিল। যেদিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলো, সেদিন এই নিদারুণ খবর এসে পৌঁছল আমাদের কাছে। আর কিছুদিন পরেই আমার ছেলের একটি ছোট কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবে। এই বইয়ে থাকবে যুদ্ধের বিষয়ে লেখা তার কবিতা। দেশের বেশির ভাগ লোক নিশ্চিন্ত আরামে নিরাপদে দেশে বসে আছে, যুদ্ধক্ষেত্রে যারা অশেষ দুঃখ-কষ্ট বরণ করছে, এমনকি প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে, তাদের জন্য কোনো মমতা বা অনুভূতি নেই-এ কথা ভেবে বাছা আমার ভারি মনোবেদনা অনুভব করত। যুদ্ধে যেকোনো পক্ষেরই কোনো লাভ নেই-এ বিষয়ে তার সংশয় মাত্র ছিল না। কিন্তু নিজের দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে সে একটি কথাও বলেনি তার কবিতায়। যারা তাকে ভালোবাসত, একমাত্র তারাই বুঝবে কী গভীর দুঃখ ছিল তার মনের মধ্যে। তা না হলে এ রকম কবিতা সে লিখতে পারত না। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫ বছর। সে ছিল সৌন্দর্যের উপাসক-তার নিজের জীবন ছিল সুন্দর, কল্যাণময়। আমি অভিযোগ করব না, ভগবান তাকে যখন টেনে নিলেন, ভালোবেসেই নিয়ে গেছেন। আমার মায়ের প্রাণ, আমি নিয়ত তাঁর কাছে কত প্রার্থনাই করেছি। তিনি প্রেমময়, তিনি যদি ভালো বুঝতেন, তাহলে তো মায়ের কোলেই সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন। সুতরাং আমি নতমস্তকেই তাঁর বিধান মেনে নিয়েছি। যত দিন এ জগতে আছি, কোনো অভিযোগ না করে নীরবে কাটিয়ে যাব। আমাদের ত্রাণ করার জন্য যিনি মানুষের রূপ ধরে এসেছিলেন, তিনি আমাদের জন্য এক অমৃতলোক রচনা করে রেখেছেন। সেখানে আমার উইলফ্রেডের সঙ্গে আমি আবার মিলিত হব। আমি যখন চিঠি লিখতে শুরু করি, তখন ভাবিনি এত কথা লিখব, চিঠি বড় হয়ে গেল বলে আমায় মার্জনা করবেন। আপনি যদি আমার ছেলের কবিতার বইখানি পড়েন, ভারি অনুগৃহীত বোধ করব। চ্যাটো অ্যান্ড উইনডাস শরৎকালের মধ্যেই বইখানি বের করবে। যদি অনুমতি দেন আমি একখানি বই আপনাকে পাঠিয়ে দেবো।
বিষন্ন মনের আঁধারে আলোর দিশারি মনোবিদ রবীন্দ্রনাথ আমার গভীর শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন। ইতি
উইলফ্রেড ওয়েনের মা
সুজান এইচ ওয়েন’
এক পুত্রহারা মাতৃহৃদয় সান্ত্বনার সন্ধান খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণার দিন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ক্লেমাঁসোও স্মরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি কঁতেস দ্য নোয়াইয়ের মুখে ‘গীতাঞ্জলি’র কিছু অংশ শুনে স্বস্তি অনুভব করেছিলেন। এভাবেই সারা জীবন ধরে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন মানুষের নানা মানসিক উৎকণ্ঠা, দ্বিধা, দ্ব›দ্ব- এমনকি শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্ত হতে সহায়ক হয়েছেন, প্রত্যক্ষভাবে অথবা চিঠিপত্রের মাধ্যমে। সেই সব চিঠিপত্র মানুষ রবীন্দ্রনাথ, কবি রবীন্দ্রনাথের এক স্বতন্ত্র স্বরূপ আমাদের সামনে উন্মোচিত করে দেয়। আত্মসচেতনতা, মনের জোর, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মবিশ্বাস মানুষকে যে কতখানি রোগমুক্ত করতে পারে এবং প্রতিটি কাজে উদ্দীপ্ত করে তোলে তার উজ্জ্বল নিদর্শন রবীন্দ্রনাথ। কবির লেখা সেই সব চিঠিপত্র নিষ্ঠার সঙ্গে অনুধাবন করলে আমরা খুঁজে পাই এক মনঃসমীক্ষক, মনোবিশ্লেষক বা মনোবিদ রবীন্দ্রনাথকে। জীবনের নানা সময়ে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং মানসিক অবসাদে ভুগেছিলেন এবং এরই পরিণতি ছিল তাঁর আত্মহত্যা করার প্রবল ইচ্ছায়। সেই সময় মানসিক অবসাদের কোনো ওষুধ ছিল না। মানসিক অবসাদ যে একটা অসুখ, সেই স্বীকৃতিও ছিল না। ছিল না সচেতনতাও। মনের জোর, আত্মবিশ্বাস ও আত্মবিশ্লেষণের দ্বারা তিনি মানসিক অবসাদকে জয় করেছিলেন বারবার। অচিরেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন স্বাভাবিক জীবনে, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কর্মযজ্ঞে। কবি বুঝতেন এই পৃথিবীতে মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে থাকতে গেলে নিজের কিছু ভালো লাগা বোধ বা কাজকে উদ্দীপ্ত করতে হবে। সে কারণেই ছেলেবেলা থেকে বারবার অবসাদের ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন কবিতা লেখা, গান লেখা ও গাওয়া, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো ও দুর্বল মুহূর্তে নিজের একান্ত কিছু সময় নির্জনে কাটানো। প্রতিটি কাজের আত্মবিশ্লেষণ কবির মনকে সমৃদ্ধ করেছে, আর এই সব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কবি তাঁর আশপাশে থাকা অসংখ্য মানুষের, প্রিয়জনের মনের দুঃখ-কষ্ট ও অবসাদ দূর করার চেষ্টা করেছেন এক অভিজ্ঞ মনোবিশ্লেষকের মতো। কবির কথা হলো, মনের দরজা খুলে দাও। সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা যা-ই থাক, মনে তা ব্যক্ত করো প্রিয়জনদের কাছে। কথা বলো, চিঠি লেখার মনের মানুষ তৈরি করো, যাকে সব বলা যায়। মনের ভালো লাগা, ভালোবাসার বোধগুলোকে জাগ্রত করো। নিজেকে একাত্ম করো তাদের সঙ্গে। কবি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতির মাঝখানে বেঁচে থাকার আনন্দ আছে, যা আমাদের চিত্তবিকলন থেকে উত্তীর্ণ করে, অন্ধকার থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসে। তিনি ভালোবাসতেন বর্ষার আকাশ, সজল মেঘ, পাখির কূজন, দিগন্তব্যাপী স্নিগ্ধরাত্রি, সোনালি রৌদ্রে নিবিড় ভাবসৌন্দর্যে ভরা দুপুর। শিমুল-পলাশরাঙা আলোর ঝলকানি, গাছপালা রোদের আলোছায়া, পুকুরে হাঁসের পাখা ঝাপটানো, শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘন বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ, শিশিরসিক্ত সুরমা সবুজের ওপর সোনা গলানো রৌদ্র। এই সব কিছুই কবির ভালোবাসা, কবির আত্মীয়, কবির অবসাদ থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পাথেয়। কবি ভালোবাসতেন গান, কবিতা, সমুদ্র আর নদী। অবসাদ কাটানোর জন্য ভালোবাসতেন একান্তে নির্জনবাস। শুধু নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া।
রবীন্দ্রনাথের মনে জ্ঞান-প্রেমের কর্ম, আনন্দের আদর্শ গড়ে উঠেছিল। নিজের স্বার্থবোধ প্রণোদিত বাসনাকে ত্যাগ করে সাধারণ মানুষ তো সুখ পায় না; তার পক্ষে এভাবে আত্মত্যাগ করাও কষ্টকর হয়। কারণ সবার চেয়ে নিজেকেই সে ভালোবাসে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, আত্মত্যাগ সম্ভব হয় যদি আমাদের প্রীতির ক্ষেত্রের বিস্তার ঘটাই। যাকে প্রীতি করি তার জন্য স্বার্থত্যাগ করতে কষ্ট হয় না, বরং ভালো লাগে। মা সন্তানের জন্য কত পরিশ্রম স্বীকার করেন, কিন্তু তাতে কষ্টবোধ হয় না। কারণ সন্তানকে পরম আত্মীয় জ্ঞান করেন। সুতরাং এ আত্মত্যাগে কষ্ট নেই, আনন্দ আছে। এ থেকে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে পড়ে। আত্মীয়তাজ্ঞান প্রীতির উদ্রেক করার সামর্থ্য রাখে। সুতরাং দেখা যায়, প্রীতি এবং কল্যাণ কর্মের মধ্যে একটি পরস্পর সংযোগ আছে; একটি অন্যের সহায়তা করে।
মানুুষের স্বাভাবিক আকুতিকে ভিত্তি করেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্ঞান, প্রেম, কর্ম, আনন্দ তত্ত গড়ে তুলেছেন। সুতরাং মানবজীবনের সার্থকতা, ক্ষুদ্র অহংবোধ প্রণোদিত হয়ে শুধু নিজের স্বার্থ সংরক্ষণের কাজে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে বুদ্ধিবৃত্তি, হৃদয়বৃত্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করায়। বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে নিজের সঙ্গে বিশ্বের মানুষের সঙ্গে একাত্মবোধ উপলব্ধি করা তার প্রথম সোপান। তা থেকেই অন্যের প্রতি প্রীতির সঞ্চার হবে এবং সেই প্রীতির ভিত্তিতে যে মমত্ববোধ সঞ্জাত হবে, তা সর্বজনীন কল্যাণকর্মে শুধু প্রেরণা দেবে না, তাকে সহজসাধ্য করে তুলবে।
এভাবে জ্ঞান, কর্ম ও প্রেমের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে যোগ স্থাপিত হলে শুধু তার স্বাভাবিক ইচ্ছা চরিতার্থ হলো না, একটি অতিরিক্ত লাভ এসে পড়ে। সর্বজনীন কাজ করে সে আনন্দ অনুভব করে। এতে শুধু তার সার্থকতা নয়, আনন্দও আছে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *