বেগম রোকেয়া : নারীমুক্তির অগ্রদূত

বেগম রোকেয়া : নারীমুক্তির অগ্রদূত

নারী ডেস্ক: উপমহাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও নারী মুক্তি আন্দোলনে যার নাম সর্বাজ্ঞে উচ্চারিত হয়, তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাবার দেওয়া নামটির সঙ্গে সাখাওয়াত শব্দটি যুক্ত হয় মূলত তার বিয়ের পরে স্বামীর নামানুসারে।


এই মহীয়সী জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে। তিনি যে পরিবার জন্মগ্রহণ করেন তা ছিল অতি রক্ষণশীল। শুধু তার পরিবারই নয়, পুরো সমাজটাই ছিল ধর্মীয় কঠোর বিধিনিষেধ দ্বারা শাসিত। সেই গোড়া মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্তেও তিনি ছিলেন আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতাসম্পন্ন একজন নারী। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার বাইরে এসে নারীদের শিক্ষা অর্জন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তিনি বড় ভাই-বোনদের উৎসাহে এবং পরবর্তী সময়ে স্বামীর সাহচর্যে শত বাধা সত্তে¡ও সেই রক্ষণশীল সমাজের বাইরে এসে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হন এবং নারীর অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হন।

তিনি দেখলেন, নারীরা যদি অন্তঃপুরেই তার জীবন কাটিয়ে দেয়, তবে নারী জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তারা কখনোই স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। তাই তিনি প্রথাগত সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করে নারীর মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করলেন। তার নারী মুক্তির আন্দোলন কোনো পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে ছিল না বরং তা ছিল পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতার বিরুদ্ধে।
বেগম রোকেয়ার আগেও উপমহাদেশে নারী মুক্তি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দুজন সমাজ সংস্কারকের নাম চিরস্মরণীয়। তাদের একজন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। যিনি একাধারে একজন বাঙালি দার্শনিক, সমাজ ও ধর্ম সংস্কারক এবং একজন খ্যাতিমান লেখক। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা এবং এর একজন অন্যতম প্রচারক।

তৎকালীন হিন্দু সমাজে একটি অমানবিক প্রথা চালু ছিল। কোনো স্ত্রীর স্বামী মারা গেলে তাকেও স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে হতো। যেটাকে বলা হতো সতীদাহ প্রথা। এটা ছিল হিন্দু সমাজের এক নিদারুণ নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার জ্বলন্ত উদাহরণ। অথচ তৎকালীন হিন্দুরা এটাকে অতি পুণ্যকর্ম মনে করতেন।

রাজা রামমোহন রায় দেখলেন, সমাজের এই প্রথাগত ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে যদি নারীকে মুক্তি দেওয়া না যায়, যদি অনাদিকাল ধরে এটা চলতে থাকে, তবে সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে; নারীরা কখনো পুরুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবে না; তাদের মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে পদে পদে। সেই কারণে তিনি শুরু করলেন সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলন। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে তার ক্ষুরধার লেখালেখি আর তীব্র আন্দোলনের কারণে ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস হয়। এ আইনের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রদ হয়েছিল ঠিকই। তবে তৎকালীন গোড়া হিন্দুরা এটাকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। কারণ এটি ছিল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের গালে চরম চপেটাঘাত।

সতীদাহ প্রথা বাতিল হওয়ার পরে সমাজে বাঁধল আরেক বিপত্তি। পতিহারা নারীরা অনেকটা গতিহারা হয়ে গেল। পতি হারিয়ে শুরু হলো তাদের ছন্নছাড়া জীবন। না স্বামীর ঘরে, না পিতার ঘরে কোথাও যেন তাদের গত্যন্তর হলো না। কারণ সমাজ এবার বাঁধ সাধল তাদের পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে। এগিয়ে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। তিনিও ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক ও বিশিষ্ট লেখক। তিনি আওয়াজ তুললেন বিধবা বিবাহের পক্ষে।

বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহও তৎকালীন হিন্দুসমাজকে গ্রাস করেছিল। তিনি এগুলোর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু করলেন। হাতে ধরলেন প্রতিবাদের কলম। ‘বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলিত হওয়া উচিত কি-না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি-না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’ ইত্যাদি রচনার মাধ্যমে এ আন্দোলনকে আরো বেগবান করলেন।
অবশেষে ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন প্রচলিত হলে হিন্দু বিধবা নারীদের সমাজে একটা গতি হলো। তবে শুধু আইন প্রণয়নেই থেমে থাকেননি তিনি। তার উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়েছিল। এমনকি নিজ পুত্রকে এক বিধবা নারীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বেগম রোকেয়া সবাই নারী আন্দোলন ও নারীমুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন ঠিকই তবে তাদের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার পার্থক্য এখানেই, পূর্বোক্ত আন্দোলনে নারীর প্রকৃত মানসিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয় ছিল প্রায় অনুপস্থিত। তারা নারীকে দেখেছিলেন সহানুভূতির দৃষ্টিতে। আর বেগম রোকেয়ার ভাবনা ছিল সেটার ঊর্ধ্বে। তিনি সহানুভূতির ঊর্ধ্বে উঠে নারীর মানসিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

চারপাশের নারী সমাজকে তিনি দেখেছেন দরদি হৃদয় ও যুক্তিবাদী মন দিয়ে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নারী যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন না হয়, তবে পুরুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে না কখনোই। তিনি চেয়েছিলেন সমাজে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক। পুরুষের পাশাপাশি তারাও উন্নয়নে এগিয়ে আসুক। নারীজাতিকে তিনি আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। এজন্য তিনি কলম ধরেছেন শক্ত হাতে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ রচনায় তিনি তার কল্পনার নারীকেই দেখিয়েছেন সমাজকে। নারীরা শুধু অন্তঃপুর ও রন্ধনশালার অন্ধকার পরাকাষ্ঠে আর কাব্য-কবিতার ছন্দে আবদ্ধ থাকবে সেটা তিনি মানতে পারতেন না। তাই তিনি বাস্তব জ্ঞানের আলোকে ‘অবরোধবাসিনী’ লিখে সমাজকে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন চোখে আঙুল দিয়ে।
বেগম রোকেয়া ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে তার কল্পনার নারীকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা অত সহজ নয়। এজন্য সমাজ ও নারীর মনোজগতে পরিবর্তন জরুরি। আর সেজন্য নারীর শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তৎকালীন সমাজে পরিবারের অর্গলমুক্ত হয়ে নারীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করা ছিল আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র। সেসময় শিক্ষাকে শুধু পুরুষের একার অধিকার মনে করা হতো। তিনি সেই সমাজের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়ে ১৯০৯ সালে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে স্বামীর নামে ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’।

যেখানে মেয়েদের শিক্ষারই কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু তিনি মনোবল হারাননি। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে এসেছেন। তাদের শিক্ষিত করে তুলেছেন। শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। নারীমুক্তির বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে নারী শিক্ষার পক্ষে জোর প্রচারণাও চালান তিনি। যদিও তৎকালীন সমাজ তার এই উদ্যোগকে ভালোভাবে নেননি। বরং নিন্দা ও ঘৃণার চোখে দেখেছেন অনেকে। তবুও কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরে বেগম রোকেয়া বুঝলেন মুসলিম নারীদের দাবি আদায়ের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দরকার। আর তাই বাংলার মুসলিম নারীদের বিভিন্ন দাবি আদায় এবং নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের সাংগঠনিক ভিত্তি সৃষ্টির জন্য ১৯১৬ সালে তিনি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি ছিল বেগম রোকেয়ার নারী আন্দোলন ও নারীমুক্তির একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ।

বেগম রোকেয়া যে পরিবারে এবং সমাজে বেড়ে ওঠেন সেখানে ভাষা হিসেবে উর্দু, ফারসি ও আরবির ছিল জয়জয়কার। এসব ভাষায় কথা বলা ও পড়াশোনা করা ছিল অনেকটা ধর্মীয় বিধিবিধানের মতো। ইংরেজি ভাষাকে মনে করা হতো বিজাতীয় ভাষা। বাংলাকেও দেখা হতো অনীহার চোখে। যদিও তিনি চোস্ত ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারতেন, তবুও সে পথে হাঁটেননি। তিনি দেখলেন বাংলার নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হলে বাংলার বিকল্প নেই। এজন্য তিনি তার সব রচনাই লিখলেন বাংলা ভাষায়। ‘সুলতানাস ড্রিম’ নামে ইংরেজিতে প্রথমে একটি বই লিখেলেও পরে সেটার বাংলা অনুবাদ করেন তিনি নিজেই। বাংলার প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ ও ভালোবাসা। সে সময় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বাংলাতে লেখাও ছিল এক ধরনের বিপ্লবী কাজ। বাংলা ভাষার প্রতি তার অবস্থান ছিল যে কত দৃঢ়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে তার জোরাল বক্তব্যের মাধ্যমে। যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ।

বেগম রোকেয়া আমৃত্যু নারীর কল্যাণ ও মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। তার সব ধ্যানে-জ্ঞানে, চিন্তা-চেতনায়, মনে ও মননে ছিল নারী। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন। তিনি যে নারীজাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীর এ পর্যায়ে এসে আজ তা কতটুকু পূর্ণ হয়েছে, তা আলোচনার বিষয় হলেও এটা অস্বীকার করার জো নেই, নারীর ক্ষমতায়ন বা নারীর মুক্তির জন্যে যে আন্দোলনের সূচনা তিনি করেছিলেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত, সমাজ সংস্কারক এই মহীয়সী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় ইহলোক ত্যাগ করেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *