হাদিস ও বিজ্ঞানের ভাষ্যে নবজাতকের ‘তাহনিক’

হাদিস ও বিজ্ঞানের ভাষ্যে নবজাতকের ‘তাহনিক’

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা: শিশুর জন্মগ্রহণের পর তাকে ‘তাহনিক’ করা সুন্নত। আমাদের প্রিয় নবিজি (সা.)-এর কাছে কোনো নবজাতক শিশুকে নিয়ে যাওয়া হলে, তিনি তাকে তাহনিক করতেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করতেন। হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে, আবু মুসা (রা.) বলেন, ‘আমার একটি পুত্রসন্তান জন্মালে আমি তাকে নিয়ে নবি (সা.)-এর কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহিম। তারপর খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। সে ছিল আবু মুসার সবচেয়ে বড় ছেলে।’ (বুখারি, হাদিস: ৫৪৬৭)

তাহনিকের পদ্ধতি হলো, খেজুর চিবিয়ে তার সামান্য রস নবজাতকের মুখে দেওয়া। হযরত রাসুল (সা.) এই পদ্ধতি তাহনিক করেছেন বলে হাদিস শরীফে পাওয়া যায়।
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে মক্কায় গর্ভে ধারণ করেন। তিনি বলেন, ‘গর্ভকাল পূর্ণ হওয়া অবস্থায় আমি বেরিয়ে মদীনায় এলাম এবং কুবায় অবতরণ করলাম। কুবাতেই আমি তাকে প্রসব করি। তারপর তাকে নিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে তাকে তাঁর কোলে রাখলাম। তিনি একটি খেজুর আনতে বলেন। তা চিবিয়ে তিনি তার মুখে দিলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর এই লালাই সর্বপ্রথম তার পেটে প্রবেশ করেছিল। তারপর তিনি খেজুর চিবিয়ে তাহনিক করলেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করলেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৫৪৬৯)

ইমাম নববি (রহ.) বলেন, সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে খেজুর দিয়ে তাহনিক করা সুন্নত। অর্থাৎ খেজুর চিবিয়ে নবজাতকের মুখের তালুতে আলতোভাবে মালিশ করা এবং তার মুখ খুলে দেওয়া, যাতে তার পেটে এর কিছু অংশ প্রবেশ করে। তিনি বলেন, কতক আলেম বলেছেন, খেজুর সম্ভব না হলে অন্য কোনো মিষ্টি দ্রব্য দিয়ে তাহনিক করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, সবার নিকটই তাহনিক করা মুস্তাহাব, আমার জানা মতে, এ ব্যাপারে কেউ ভিন্ন মত পোষণ করেননি। (শরহে মুহাজ্জাব: ৮/৪২৪)
গণমাধ্যম ও বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, চিকিৎসাবিজ্ঞানে নবজাতককে বিভিন্ন রোগব্যধি থেকে বাঁচানোর জন্য ‘সুগার জেল’ ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে, যা নবিজি (সা.)-এর এই সুন্নতের সঙ্গে মিলে যায়।

২০২১ সালে ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, হাইপোগ্লাইসেমিয়া ঝুঁকিতে থাকা নবজাতক শিশুদের মুখের ভেতরে চিনির জেল (মিষ্টান্ন) ঘষলে তাদের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
মানুষের শরীরের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ একটা নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নেমে গেলে তাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে। শিশুর হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে খিঁচুনি, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ তার যেকোনো ধরনের স্নায়বিক সমস্যা হতে পারে।


অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগিন্স ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এমন শিশুদের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়, যারা পরিপক্ব হওয়ার আগে জন্মগ্রহণ করে, উচ্চ বা কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে কিংবা তাদের মা গর্ভকালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকায় হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকিতে ছিল।

নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ১৮টি ম্যাটার্নিটি হাসপাতালের দুই হাজার ১৪৯টি নবজাতকের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হয়, সেখানে দেখা যায় জন্মের পর তাদের মুখে সুগার জেল (মিষ্টান্ন) দেওয়ার কারণে প্রতি ২১ জনে একটি শিশু হাইপোগ¬াইসেমিয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেয়েছে।

এ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্মের পর নবজাতকের মুখে ঘষে দেওয়া এক ডোজ মিষ্টান্ন প্রি-ম্যাচিউর (অপরিপক্ব) বাচ্চাদের মস্তিষ্কের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার একটি কার্যকর ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি হতে পারে। কারণ জন্মের পর লো ব্লাড সুগার প্রতি ১০ শিশুর একটির ওপর খুব বিপজ্জনকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। নব আবিষ্কৃত এই চিকিৎসাপদ্ধতিকে বলা হয় জেল থেরাপি।


হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে এই সুন্নতের ওপর আমল করলে একদিকে যেমন সুন্নত পালনের সওয়াব পাওয়া যাবে, তেমনি সন্তানও বিভিন্ন রোগব্যধি থেকে মুক্ত থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *