মরমি কবি সিরাজুল ইসলাম

মরমি কবি সিরাজুল ইসলাম

মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ: বাংলাদেশে মুসলিম সংস্কৃতির জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ধ্যানী, স্বল্পবাক, গভীর চিন্তার মরমি কবি সিরাজুল ইসলাম। ১৯৩০ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার রসুলপুর গকুলচর গ্রামে কবির জন্ম। অত্যন্ত ভাবগম্ভীর মরমি কবি সিরাজুল ইসলাম পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই লেখালেখি শুরু করেন। মহান আল্লাহ্র মহিমা বর্ণনায় তাঁর নিবেদন:


‘আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালুহু
শেষ করা তো যায় না গেয়ে
তোমার গুণগান।
….তুমি মাটির আদমকে
প্রথম সৃষ্টি করিয়া
ঘোষণা করিয়া দিলে
শ্রেষ্ঠ বলিয়া।
…শিশু মুসা নবীরে
যখন দুশমনেরি ডরে
সিন্দুকে ভরিয়া দিলে
ভাসাইয়া সাগরে।
প্রাণে ছিল তাহার ভয়
সেথা পেল সে আশ্রয়।
…যখন ইউনুছ নবীরে খাইল মাছেতে গিলিয়া
ফেরেশতা পাঠাইলে তুমি এছমে আজম দিয়া…।


বহতার নদীর মতোই বাঙালির অনুভবে প্রিয় নবি (সা.)-এর অবস্থান যে কত গৌরবের, সিরাজুল ইসলামের উচ্চারণে তা স্পষ্ট হয়:


নবী মোর পরশ মণি
নবী মোর সোনার খনি
নবী নাম জপে যে জন সেই তো দোজাহানের ধনী॥
…নিদানে আখেরাতে
ত্বরাইতে পুলসিরাতে
কাণ্ডারী হইয়া নবী পার করিবেন সেই তরণী॥


রক্ষণশীল প্রথা ভেঙে কবি সিরাজুল ইসলাম ১৯৪৮ সালে সংগীতে তালিম নেন এবং গান লেখা ও সুরারোপ শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি রেডিওর, ১৯৬৪ সালে টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। অসংখ্য আধুনিক, দেশাত্মবোধক, মারফতি, মুর্শিদি, মরমি ইত্যাদি গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম, যেমন: এখনও সময় আছে আল্লাহ নবীর নাম লও, বলে দাও মাটির পৃথিবী কোথা শান্তি আমার জীবনে, কোকিল ডাকিস নারে আর, এলো বসন্তের বাহার, তোমার দুহাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম, থাকব তোমারই ওগো কথা দিলাম, কে যাও তুমি ভাটির দেশে ও বিদেশি নাইয়া ইত্যাদি।
সিরাজুল ইসলামের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আব্দুল আলীম, ফেরদৌসী রহমান, মাহমুদুন নবী, খুরশিদ আলম, সাবিনা ইয়াসমীন, শাহনাজ রহমতাউল্লাহ, মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার, বশির আহমেদ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, সুবির নন্দীসহ খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পীরা। এখনো শোনা যায়:


মন ভোমরা মজলি না তুই
রাসুল নামের রসে
ও তুই গাইলি না তাহার গুণগান
রইলি না নিজ বশে…।


সিরাজুল ইসলামের বইয়ের সংখ্যা ২৫টি। যেমন-হলুদিয়া পাখি, রক্তিম আলিঙ্গন, রক্তপলাশ, দুটি পাখি একটি নীড়, আকাশ মাটি মানুষ মন, বন্ধু ওগো সুপ্রভাত, আমি মুক্ত বলাকা, সুজন নাইয়া ইত্যাদি।
নিজের সঞ্চিত তেমন কোনো অর্থ ছিল না তার, ছিল যা তা-ই নিজ বাড়িতে ‘বই বাগান’ নামক একটি পাঠাগারের জন্য দান করে গেছেন কবি সিরাজুল ইসলাম। চোখ অপারেশনের ফলে প্রচণ্ড আর্থিক দুরবস্থায় পড়েন তিনি। আর্থিক দুর্দশায় প্রায় বিনা চিকিৎসায় ২০০২ সালের ৯ জুন ৭২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এ তো তাঁরই সৃষ্টির অনুপম বাস্তবতা:


আমার প্রাণের প্রাণ পাখি
আমার হিরামন পাখি
তোরে কোথায় রাখি
পাখিরে সবই মিছে আর ফাঁকি॥
পাখিরে ..রে রে..এ..এ..
এক পলকের নাই ভরসা
মিছে সকল আশা…
ও পাখিরে ..রে রে..এ..
মিছা মায়ায় বন্দি হইয়া
কর কত খেলা
পশ্চিমে তাকাইয়া দেখ।
ডুইবা আইলো বেলা…॥


মৃত্যুর পরে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কবি সিরাজুল ইসলাম পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয় কেরানীগঞ্জে। কিন্তু ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে কবি সিরাজুল ইসলাম পাবলিক লাইব্রেরিটি বন্ধ করে সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়।
কবির গড়া ‘বই বাগান’ নামক প্রতিষ্ঠানটির জন্য ‘কবি সিরাজুল ইসলাম স্মৃতি সংসদ’ কমিটি গঠন করা হলেও দীর্ঘদিন কোনো কার্যক্রম নেই ওই কমিটির। কেরানীগঞ্জের বর্তমান প্রজন্ম কবি সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *