নবি পরিবারের নারীদের আত্মত্যাগ

নবি পরিবারের নারীদের আত্মত্যাগ

মো. আবদুল মজিদ মোল্লা: মহানবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন তাঁর জীবনচরিতের সর্বোত্তম ভাষ্যকার। কেননা হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনযাত্রায় তাঁরাই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী, তাঁর সুখ-দুঃখের সবচেয়ে বড় অংশীদার, বিশেষ করে এক্ষেত্রে নবি পরিবারের নারীদের অবদান অবিস্মরণীয়। কেননা তাঁদের মাধ্যমেই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ইসলামের প্রায়োগিক রূপরেখা উম্মাহর সামনে প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামের অন্য বিষয়গুলোও তাঁদের বক্তব্যের সংযোগে পূর্ণতা লাভ করেছে।
নবি পরিবারের বিশেষ মর্যাদা
হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিবারের মর্যাদা কুরআনের একাধিক আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘হে নবি পরিবার! আল্লাহ্ তো তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে চান এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে চান।’ (সূরা আহজাব ৩৩: আয়াত ৩৩)
নবি পরিবারে নারীর মর্যাদা
পরিবারে নারীদের প্রতি নবিজি (সা.) অত্যন্ত স্নেহশীল এবং তাঁদের অধিকার রক্ষায় সচেতন ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পার্থিব বস্তুর মধ্যে স্ত্রী ও সুগন্ধি আমার কাছে পছন্দনীয় করা হয়েছে এবং নামাজে রাখা হয়েছে আমার চোখের প্রশান্তি। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস ৩৯৩৯) কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে নবিজি (সা.) বলেন, প্রকৃতপক্ষে ফাতিমা আমারই অংশ, যা তাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকেও কষ্ট দেয়, যা তাকে ক্লান্ত করে তা আমাকেও ক্লান্ত করে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস ৩৮৬৯)
যাঁরা যেভাবে অবদান রেখেছেন
সার্বিক বিবেচনায় নবি পরিবারের নারীদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। তা হলো- ১. যাঁরা নবিজি (সা.)-এর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন, ২. যাঁরা নবিজি (সা.)-এর পরও জীবিত ছিলেন। প্রথম শ্রেণি মহানবি (সা.)-এর সেবা, ইসলামের জন্য কষ্ট স্বীকার ও আত্মত্যাগ বেশি করেছিলেন। আর দ্বিতীয় শ্রেণি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রাপ্ত ইসলামের শিক্ষা ও নবিজি (সা.)-এর বাণী মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেন।
নবি পরিবারের নারীদের আত্মত্যাগ
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় নবি পরিবারের নারীদের ভেতর যাঁরা ইন্তেকাল করেন, তাঁদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হলেন মা খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ও নবিজি (সা.)-এর তিন কন্যা। এছাড়া হযরত রাসুল (সা.)-এর চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ (রা.)-ও প্রণিধানযোগ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের কয়েক মাস পর মা ফাতেমা (রা.)-ও ইন্তেকাল করেন।
মক্কার কঠিন জীবনে তাঁরা সবাই ছিলেন মহানবি (সা.)-এর ছায়াসঙ্গী। নবিজি (সা.)-এর মতো তাঁরা মক্কার মুশরিকদের অত্যাচার সহ্য করেন, বিশেষত শিআবে আবি তালিবের অবরুদ্ধ দিনগুলোতে অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেন তাঁরা। খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ছাড়া অন্যরা ইসলামের জন্য মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদীনায় চলে আসেন। হিজরতের আগেই মা খাদিজা (রা.)-এর ওফাত হয়।
দাদা আবদুল মুত্তালিব (আ.)-এর ইন্তেকালের পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আবু তালিব (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন। আবু তালিবের স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আসাদ (রা.) নবিজি (সা.)-কে সন্তানের মতোই গ্রহণ করেন।
হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) স্ত্রীদের মধ্যে নবিজি (সা.)-এর জন্য সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ স্বীকার করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে তিনি ছিলেন আরবের ধনাঢ্য নারীদের একজন। বিয়ের পর নিজের সমুদয় অর্থ-সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য ব্যয় করেন। নবুয়ত লাভের আগে নবিজি (সা.) যখন নিঃসঙ্গ প্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তিনি গারে হেরায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন, তখন খাদিজা (রা.) নিয়মিত খাবার নিয়ে সেখানে হাজির হতেন। প্রথম ওহি আসার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ভয় পেলে তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, আল্লাহর কসম, কখনই নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানকে আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদিজা (রা.)-এর ত্যাগের স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে তাঁর চেয়ে উত্তম কাউকে দেননি। কেননা যখন মানুষ আমার সঙ্গে কুফরি করেছিল তখন খাদিজা আমার ওপর ইমান এনেছিল, যখন মানুষ আমাকে অবিশ্বাস করেছিল তখন সে আমাকে সত্যায়ন করেছিল, যখন মানুষ আমাকে বঞ্চিত করেছিল তখন সে আমাকে তার সম্পদে অংশীদার করেছিল, তার গর্ভ থেকে আল্লাহ আমাকে সন্তান দান করেছেন অন্য কোনো স্ত্রীর গর্ভ থেকে আমাকে কোনো সন্তান দেওয়া হয়নি। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৪৮৬৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যারাও এই আত্মত্যাগের অংশীদার। তাঁরা ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অগ্রগামী। বয়সে নবীন হলেও তাঁরা ইসলামের জন্য ত্যাগ স্বীকারে কখনো পিছপা হননি। ঐতিহাসিকরা লেখেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কাবাসীকে ইমানের আহ্বান জানালে আবু লাহাব ও তার পবিবার উৎপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আবু লাহাবের নিন্দায় সুরা লাহাব অবতীর্ণ হলে তার দুই ছেলে উতবা ও উতাইবা পিতার নির্দেশে মহানবি (সা.)-এর দুই কন্যা রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুমকে তালাক দেয়। অবশ্য তখনো তাঁদের উঠিয়ে দেওয়া হয়নি, কেবল আকদ হয়েছিল। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস: ১/২৯৭)
একদিন মহানবি (সা.) মসজিদুল হারামে সিজদারত অবস্থায় ছিলেন। তখন উকবা ইবনে আবি মুয়িত আল্লাহর রাসুলের মাথার ওপর মরা উটের নাড়ি-ভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়। ফলে তিনি উঠতে পারছিলেন না। মা ফাতিমা (রা.) দৌঁড়ে এসে তাঁর ওপর থেকে নাড়ি-ভুঁড়ি সরিয়ে দেন। ভারমুক্ত হওয়ার পর হযরত রাসুল (সা.) ওই পাষণ্ডসহ আরো কয়েকজনের নাম ধরে বদদোয়া করেন। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১০৪) আল্লাহ মোহাম্মদ (সা.), তাঁর পরিবার, সাহাবি ও কিয়ামত পর্যন্ত আসা তাঁর সব অনুসারীর প্রতি শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। আমিন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *