নজরুল কাব্যে প্রেম ও সৌন্দর্য

নজরুল কাব্যে প্রেম ও সৌন্দর্য

‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম; সে প্রেম পেলাম না’! এই না পাওয়ার বেদনায় ক্ষুণ্ন হয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন কবি নজরুল। এ পর্যায়েই তাঁর যৌবনসত্তা দ্বিখন্ডিত হয়েছে প্রেমে ও বিদ্রোহে। বিদ্রোহ তাঁর প্রেমিক হূদয়েরই বহিঃপ্রকাশ। যৌবনের উজ্জ্বল স্বপ্নে বিভোর নজরুলের প্রেমের কবিতা। যে বন্ধনহীন তারুণ্য তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল, তা-ই তাঁর প্রেমের কবিতার মূল শক্তি
ড. রফিকুল ইসলাম নজরুলের প্রেমের স্বরূপ সম্পর্কে বলছেন-‘প্রেমের যে রোমান্টিক বিষণ্নতার শুরু বিহারীলালের গীতি কবিতায়, তার চরম উৎকর্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ সেন, গোবিন্দ চন্দ্র দাস এবং মোহিতলাল মজুমদারে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেহজ আবেগের উত্তাপ-নজরুলের প্রেমের কবিতা সে ধারারই অনুসারী’।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্মম অর্থনৈতিক এবং সামাজিক আঘাতে বিলাসী প্রেমের স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি অধিকতর বাস্তবমুখী হয়ে উঠেছে। নৈর্ব্যক্তিক প্রেম চেতনার বদলে দেখা দিয়েছে ভোগসর্বস্ব প্রেম। মোহিতলাল ভোগবাদী হয়েও কখনো কখনো দার্শনিক হয়ে উঠেছেন প্রেমের ক্ষেত্রে। স্মৃতিচারণের জন্য যতীন সেনগুপ্তের কবিতা যৌবনোত্তাপ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু নজরুলের প্রেমের কবিতায় কাতরতা বা শিথিলতা নেই। জড়তা বা স্থবিরতাও নেই। নেই কোনো রকম দার্শনিকতা।
অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ রায় বলছেন, ‘নজরুলের প্রেমানুভূতির পূর্ণতা প্রেমেই। আরেকটি বৃহত্তর ব্যাখ্যায় তিনি প্রেমের স্বরূপ নির্ণয় করতে চাননি। মানবীয় কামনাকে বিচিত্র রেখাঙ্কনে ও লীলাভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।’
প্রিয় এবার সঁপে দিলাম তোমার চরণতলে,
তুমি শুধু মুখ তুলে চাও, বলুক যে যা বলে।
[সমর্পণ, দোলন চাঁপা]
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে যে প্রেম শিশু, মঙ্গলকাব্যে তার গায়ে এসেছে কৈশোরত্ব। যৌবনের দু’ক‚লপ্লাবী প্রেমবন্যায় বৈষ্ণব কবিতা টলমল। বৈষ্ণব কবিতায় প্রভাবিত বিহারীলালের কবিতা একান্ত মানবীয় নয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনাসক্ত যৌবনের পূজারী। তাঁর প্রেম ভোগবিমুখ-‘নিবাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে’। কিন্তু নজরুল প্রেমবিহারী, প্রেমপূজারী। রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁর প্রেম দেহ থেকে দেহাতীতে, ইন্দ্রিয় থেকে ইন্দ্রিয়াতীতে দার্শনিক পরিণতি লাভ করেনি।
চাহিনা দেবীর দয়া, যাচি প্রিয়ার আঁখিজল,
একটু দুখে অভিমানে নয়ন টলমল।
[এ মোর অহংকার, চক্রবাক]
রূপজ প্রেমের অনুরাগী কবি প্রিয়ার রূপ বর্ণনা করেছেন-
মৃণাল হাত / নয়ন পাত
গালের টোল / চিবুক দোল
সকল কাজ / করায় ভুল
[দোদুল দুল, দোলন চাঁপা]
রবীন্দ্রনাথ ‘পূরবী’তে প্রেমের স্মৃতিচারণ করে আবেগ চঞ্চল প্রথম যৌবনকে অস্বীকার করেছেন। তিনি অনাসক্ত দ্বিতীয় যৌবনের পূজা করেছেন। নজরুলের কাব্যে দ্বিতীয় যৌবন নেই। নজরুলের প্রেম প্রথম যৌবনের উচ্ছাস। তাঁর কাব্যে বিরহ নর-নারীর দেহগত মিলনের বিপরীত অর্থে ব্যবহূত হয়েছে-
আজি বিদায়ের আগে,
আমারে জানাতে তোমারে জানিতে কত কি যে সাধ জাগে।
[বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি, চক্রবাক]
কোনো কোনো সময় আবার নজরুলের বিরহ বিলাসও দেখা যায়-
আমি হেথা রচি গান নব নীপমালা,
স্মরণ পারের প্রিয়া একান্তে নিরালা।
[তোমারে পড়িছে মনে, চক্রবাক]
নজরুলের বিদ্রোহ ছিল যুগেরই দাবি। অসহযোগ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। কিন্তু তাঁর মূল কবি-চাহিদা ছিল প্রেমিক হূদয়ের চাহিদা। প্রতিকুল পরিবেশের প্রভাবে নজরুল প্রেমিক থেকে হলেন বিদ্রোহী। কিন্তু সেই বিদ্রোহের মধ্যে প্রেমই প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। প্রচন্ড বিদ্রোহের মধ্যেও নজরুল ভুলেননি তাঁর প্রেমিক সত্তাকে-
আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হূদি সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি।
[বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা]
প্রেমানুভূতিই নজরুলকাব্যের মূল সুর। ‘দোলন চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘পূবের হাওয়া’ এবং ‘চক্রবাক’-এ আমরা প্রেমিক নজরুলকে পাই। রবীন্দ্রকাব্যে বারবার পট পরিবর্তনের যে সূচনা হয়েছিল, নজরুলকাব্যে ক্ষণিকের জন্য হলেও সে পরিবর্তনের সূচনা সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে ‘দোলন চাঁপা’য়। দোলন চাঁপার ‘পূজারিনী’ কবিতাটি নজরুলের প্রেমকাব্যের শ্রেষ্ঠতম ফসল। এ প্রসঙ্গে আব্দুল আজিজ আল আমান বলছেন-“বিহারীলালের ‘সারদা’, রবীন্দ্রনাথের ‘মানস সুন্দরী’ এবং শেলীর ‘এপিসাইকিডিয়ান’-এর মতো নজরুলের ‘পূজারিনী’ কবিতাটি কবির প্রেম চেতনার মহাভাষ্য হয়ে উঠেছে।”
ইহাদের অতিলোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়
যাচে বহুজন
[পূজারিনী, দোলন চাঁপা]
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নারীর প্রেমেই ধরা দিয়েছেন, আত্মসমর্পণ করেছেন কবি-
হে মোর রাণী, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে,
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।
[বিজয়িনী, দোলন চাঁপা]
জাত রোমান্টিক কবি নজরুলের প্রেমের কবিতায় রোমান্টিকতা অনবদ্য হয়ে উঠেছে-
ওগো বাদলের পরী
যাবে কোন্ দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী।
[বর্ষা বিদায়, চক্রবাক]
প্রেমের কবিতায় নজরুল অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠ এবং ঘোষণা তৎপর বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এ কথা সবসময় সত্যি নয়। তাঁর এমন অনেক কবিতা আছে, যেখানে কবি উচ্ছাসহীন এবং সংযত-
বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মতো কি,
ঝুরবে তুমি একলা মনে বনের কেতকী।
[চোখের চাতক]
একদিকে গভীর ভালোবাসা আরেকদিকে সৌন্দর্যচেতনা কবির প্রেমের কবিতাকে প্রত্যয়ী করেছে দৃঢ়ভাবে। কিন্তু প্রেমের পূর্ণ পরিণতি নেই তাঁর কাব্যে। অসময়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে যাওয়া কবি তাঁর কাব্যজীবনের শেষদিকে ভক্তিবাদ এবং অধ্যাত্মচেতনায় নিমগ্ন হয়েছেন। বিদ্রোহ এবং উদ্দাম দেহকামনা শান্ত হয়ে এসেছিল তাঁর কবিতায়-
যেন আর না কাঁদায় দ্ব›দ্ব বিরোধ, হে মোর জীবন স্বামী,
এবার এক হয়ে যাক্, প্রেমে তোমার তুমি, আমার আমি।
[শেষ প্রার্থনা, দোলন চাঁপা]
এক অনির্দ্দেশ্য অসীমের দিকে বাঁক নিচ্ছিল তাঁর কবিতা। কিন্তু তারপরেই ধীরে ধীরে নীরব হয়ে গেলেন কবি।
নজরুল রেখে গেছেন তাঁর গভীর প্রেমের কবিতা। কাজী আব্দুল ওদুদ বলছেন-‘প্রেম শাশ্বত হৃদয়বৃত্তি। নজরুল বিদ্রোহী কবি হলেও মূলত প্রেমের কবি ছিলেন। তাঁর প্রেমের কবিতা তাঁকে অমর করে রাখবে’।
সংকলিত

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *