২০২৪ সালে অর্থনীতির জন্য চাই সমন্বিত ও সাহসী পদক্ষেপ

২০২৪ সালে অর্থনীতির জন্য চাই সমন্বিত ও সাহসী পদক্ষেপ

জাভেদ আখতার: ‘সময়টা একদিকে ছিল সবচেয়ে সেরা, একই সঙ্গে সবচেয়ে খারাপ। এটা ছিল একই সঙ্গে আশার বসন্ত আর হতাশার শীত। আমাদের সামনে একই সঙ্গে ছিল অপার সম্ভাবনা আর দুর্যোগের ঘনঘটা।’ [আ টেল অব টু সিটিজ, চার্লস ডিকেন্স, ১৮৫৯] দেড় শ বছরেরও বেশি সময় আগে ফরাসি বিপ্লবের পটভূমিতে লেখা লাইনগুলো বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি যথার্থ বিবরণ বলে মনে হচ্ছে।

হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক শক্তিগুলো কখনোই এতটা মুখোমুখি অবস্থানে ছিল না। জাতিসংঘও এতটা অকার্যকর পরিস্থিতিতে ছিল না। রাশিয়া-ইউক্রেন বা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের পাশাপাশি তাইওয়ান নিয়ে চীনের অবস্থান অথবা সম্প্রতি লোহিত সাগরের সংঘাত বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করছে।

এ কারণে শুধু রক্তক্ষয়, সম্পদ বিনষ্ট বা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হচ্ছে না, পরিবেশদূষণ, ক্ষুধামুক্তিসহ টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিক থেকেও আমাদের দৃষ্টি সরে যাচ্ছে।

প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ, যেমন-সিরিয়া ও তুরস্কের ভূমিকম্প বা ফ্রেডি, নার্গিস বা অতি সম্প্রতি মেছায়ংয়ের মতো ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতিও বিশ্বজুড়ে তেমন আলোচিত হচ্ছে না। বরং আমাদের সবার, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের নেতৃত্বের নির্লিপ্ততার কারণে জলবায়ু আর বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হচ্ছে না। কনফারেন্স অব পার্টিজের (কপ) মতো উদ্যোগগুলো কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছাড়াই শেষ হচ্ছে।

ফাইভজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বা এআইয়ের মতো প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কিছু যুগান্তকারী সাফল্য এলেও ২০২৩ সালের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতি।


বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফের প্রাক্কলন অনুসারে, বৈশ্বিক অর্থনীতি ২০২৩ সালে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির শিখর থেকে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলেও পুনরুদ্ধারের হার বেশ কম ছিল। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার আশাব্যঞ্জক হলেও ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়নি।

বিগত বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। এ নিয়ে বেশ কিছু পূর্বাভাসও আমাদের কাছে ছিল। অনেক বিশেষজ্ঞ আর বিশ্লেষকের মতে, পূর্বাভাস অনুসারে সাধারণ কিছু ইকোনমিক পলিসি দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো আমাদের অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল অবস্থানে থাকত।


এ অবস্থায় আমরা একটি নতুন বছর শুরু করতে যাচ্ছি। আমার প্রত্যাশা থাকবে, ২০২৪ সালের শেষে আমরা অতীতের সমস্যাগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করার পরিবর্তে সামনের সম্ভাবনা নিয়ে বেশি আলোচনা করতে পারব। তবে ২০২৩ সালের আমাদের পদক্ষেপগুলো অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করে ২০২৪ সালের জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে; যেমন-২০২২ সালের শেষ দিকে আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় আমাদের ২০২০-২১ সালের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল। কভিড-১৯-এর কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে আমাদের আমদানি ছিল তুলনামূলক কম, যার কারণে আমাদের রিজার্ভে বেশ উদ্বৃত্ত ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে আমাদের মোট আমদানি ব্যয় ছিল জিডিপির প্রায় ২১ শতাংশ। আমদানির এই হার কভিড-১৯ পূর্ববর্তী ২০১৯ সালে ছিল ১৮ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ছিল মাত্র ১৫.৮ শতাংশ।


বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীল অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ২০২২ সালের শুরু থেকেই আমাদের আরো সতর্ক আর কৌশলী হওয়া উচিত ছিল। পরে ২০২৩ সালে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ভূমিকা নেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রেও কিছু অসামঞ্জস্য দেখা গেছে। যেমন-কিছু বিলাসবহুল দ্রব্যের আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস না পেলেও আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানের কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারির মতো প্রবৃদ্ধি সহায়ক আমদানিও ব্যাহত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি প্রায় ২৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যার কারণে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে আমাদের উৎপাদকদের উৎপাদনশীলতা, সক্ষমতা, কর্মসংস্থান বা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

তবে ২০২৩ সালের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ইউএস ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার। বাজার অর্থনীতির মূলনীতি অনুসরণ করে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারভিত্তিক দাম সমন্বয় না করে কৃত্রিমভাবে দাম ধরে রাখার প্রচেষ্টা আমাদের কোনো সুফল দেয়নি। বরং এই প্রচেষ্টার সুদূরপ্রসারী ফলাফল পরবর্তী সময়ে আমরা অনুভব করেছি এবং আগামী আরো কিছুদিন অর্থনীতিতে এই প্রচেষ্টার নেতিবাচক প্রভাব থাকবে।


বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের জন্যও ২০২৩ সাল আশাব্যঞ্জক ছিল না। ২০২৩ সালে আমাদের দেশে এফডিআইয়ের পরিমাণ প্রায় ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
আমাদের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার শুরুটা পারিপার্শ্বিকতার কারণে হলেও সেই পরিস্থিতি আগে থেকেই অনুমান করা বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাতসহ আমরা সবাই, সমষ্টিগতভাবে কতটুকু সক্ষমতা বা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছি, তা আমাদের নিজেদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০২৩ সালের চ্যালেঞ্জগুলোর চেয়ে আরো অনেক কঠিন সমস্যা আগামী দিনগুলোতে আমাদের সামনে আসবে। সেই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার যথাযথ প্রস্তুতি ও সক্ষমতা আমাদের থাকতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থান আর প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য আনার চিরাচরিত অনেক ধারণা আর পদ্ধতিই আমাদের অর্থনীতির জন্য আর প্রযোজ্য হবে না। আমাদের বাস্তবসম্মত কিন্তু নতুন, উদ্ভাবনী, আউট অব দ্য বক্স প্লে-বুক চিন্তা করতে হবে।


আশার ব্যাপার হচ্ছে, ২০২২-২৩ সালে অবকাঠামো উন্নয়নের পেছনে দূরদর্শী আর সাহসী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। ভৌত অবকাঠামোর মতো আর্থিক খাত নিয়েও একই রকম সাহসী সংস্কার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দুটি উদাহরণ এখানে বেশ প্রাসঙ্গিক।

১৯৯১ সালে ভারতকে তাদের রিজার্ভের সংকটের কারণে আইএমএফের সহযোগিতা নিতে হয়েছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে ভারত যে শিক্ষা নিয়েছিল, তার ফলাফল ছিল তাদের সাহসী, উদারমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার। তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে ভারত তার বৈদেশিক বিনিয়োগ আর আর্থিক খাতে বেশ কিছু সংস্কার করে। এই পদক্ষেপগুলোর ইতিবাচক প্রভাবের কারণে ভারতকে এমনকি আইএমএফের ঋণের পরবর্তী কিস্তিগুলোও নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।

একইভাবে সঠিক খাত, যেমন-অপরিশোধিত ক্রুড অয়েল বা তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা অর্জনে বিনিয়োগ করার কারণে সাম্প্রতিক জ্বালানিসংকটের সময়ও ভারত বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে সেই তেল কম খরচে প্রক্রিয়াকরণ করতে সক্ষম হয়েছে, যা তাদের অর্থনীতিকে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল রেখেছে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাত বর্তমানে একই মাত্রার একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দায়বদ্ধতা আর পেশাদারির অভাবের কারণে এই খাতের ওপর মানুষের প্রয়োজনীয় আস্থা এখন শূন্যের কোঠায়। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে, দ্রুততম সময়ে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন বা অধিগ্রহণের মতো সাহসী সংস্কার করা না হলে অচিরেই এই খাতের সমস্যা আমাদের সবার সমস্যা হয়ে দেখা দেবে।


একইভাবে ভারতের মতো বাংলাদেশের কাছেও বিকল্প উৎস থেকে কম মূল্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সংগ্রহের সুযোগ থাকলেও আমরা কারিগরি সক্ষমতার অভাবের কারণে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। অথচ প্রায় এক দশক ধরেই আমরা ক্রুড অয়েল পরিশোধনে বিনিয়োগ করার কথা বিবেচনা করছি। প্রথম সারির অর্থনীতির দেশ হতে হলে আমাদের এ ধরনের কারিগরি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাহসী আর দূরদর্শী হতে হবে।


বর্তমানে অস্থিতিশীলতা আর অস্বস্তি থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বিকাশমান পর্যায়ে আছে এবং এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। যেহেতু আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়া, সেই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের উচিত অর্থনৈতিক সমীকরণগুলোকে নতুনভাবে চিন্তা করা, যাতে আমরা আরো ফিউচার-ফিট ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং ভবিষ্যতে এ রকম নেতিবাচক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের অর্থনীতি আরো বেশি সহনশীল হয়। বিশ্বের সেরা অর্থনীতিগুলোর একটি হতে হলে আমাদের অর্থনীতিকেও ডাইনামিক হতে হবে। বিরূপ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতেও সঠিকভাবে ঝুঁকি চিহ্নিত করে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


২০২৩ সালে একটি ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিতভাবেই সফল হইনি। তা হচ্ছে কাঠামোগতভাবে বেসরকারি খাতসহ সবার সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা আর কারিগরি দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত বিশ্লেষণ করে কার্যকর আর ডাইনামিক কর্মপরিকল্পনা করা। যদিও এক্ষেত্রে কাউকে এককভাবে দায়ী করা উচিত হবে না, কিন্তু বিভিন্ন খাতের পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ আমাদের ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এফএমসিজি খাতের কম্পানিগুলোর কাছে দেশের ভোক্তাদের চাহিদা, ক্রয়ক্ষমতা ও বৈশ্বিক বাজারের পণ্যের দাম নিয়ে নানা পূর্বাভাস ছিল। এই তথ্যগুলো সঠিকভাবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজে লাগানো গেলে হয়তো ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমত, পাশাপাশি এই খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ের নির্ধারিত লক্ষ্যেরও একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যেত।


২০২৩ সালে আমাদের আরো একটি উন্নতির ক্ষেত্র ছিল; তা হলো এফডিআই আকর্ষণ করা। নতুন এফডিআই এলে আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টে যেমন কিছুটা স্বস্তি আসবে, তেমনি আমাদের দেশে নতুন আমদানি বিকল্প শিল্প গড়ে ওঠা, নতুন কর্মসংস্থান, দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে আমাদের অবস্থানের উন্নতির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার, শ্রমশক্তি, অবকাঠামো, ভৌগোলিক অবস্থান, জ্বালানি নিরাপত্তাসহ বেশ কিছু কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ থাকার পরও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আমাদের দেশের ইনভেস্টমেন্ট ব্র্যান্ড ইমেজের বেশ ঘাটতি রয়েছে। এফডিআই বৃদ্ধি করতে আমাদের ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে আরো অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো তাদের বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞ, অনাবাসী নাগরিক ও দেশগুলোতে বিনিয়োগ করা বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ত করে সাফল্য পেয়েছে।


২০২৩ সালে অর্থনীতি আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কারণে টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। সরকার যদিও জনগণকেন্দ্রিক টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক মঞ্চে সক্রিয় অংশগ্রহণ আর অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়ন—উভয় ক্ষেত্রেই বেশ সচেতন, কিন্তু সামনের দিনগুলোতে আঞ্চলিক নেতৃস্থানীয় অবস্থান ধরে রাখতে আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।


অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় নারীদের, বিশেষ করে প্রান্তিক নারী ও মেয়েদের বেকারত্ব, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনুকরণীয় সাফল্য থাকলেও বাংলাদেশের ৪৬ শতাংশ মেয়েশিশু এখনো তাদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। আবার ২০২২ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আনুষ্ঠানিক খাত বা নিয়মিত বেতনভুক্ত শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
আমরা ২০২৪ সালে প্রবেশ করছি আমাদের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ও সংকল্প নিয়ে। অর্থনৈতিক বিকাশ, সামাজিক প্রগতি আর পরিবেশ সংরক্ষণ—এই তিনটি ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে প্রয়োজন অনেক বেশি সমন্বয় আর সহযোগিতার। বৈশ্বিক লক্ষ্য আর ২০৪১ সালের রূপকল্প অনুসারে, বেসরকারি খাতসহ সবাইকে সম্পৃক্ত করে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের কৌশল ও অগ্রাধিকারগুলোর পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন।


বিশেষ করে যেহেতু দেশের জিডিপিতে খরচ আর বিনিয়োগ মিলিয়ে প্রাইভেট সেক্টরের অবদান ৯০ শতাংশের বেশি, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সঠিক সময়ে বেসরকারি খাতের আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হলে তা লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করবে।


বিশ্বের অনেক দেশেই বেসরকারি খাতের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের সমন্বয় আর সহযোগিতার জন্য আনুষ্ঠানিক, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফোরাম আছে। বাংলাদেশের জন্যও আমাদের এ ধরনের একটি কার্যকর ও ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যেখানে ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারী, বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী আর নীতিনির্ধারকরা তাঁদের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে আর টেকসই উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অবদান রাখবেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে হলে আমাদের একসঙ্গে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের ঝুঁকি নিতে হবে, কিন্তু একই সঙ্গে সেই ঝুঁকি ক্যালকুলেটেড হতে হবে। রাইট ব্রাদারস বা ক্রিস্টোফার কলম্বাস কিন্তু অনুমান নয়, বৈজ্ঞানিক তথ্য বিবেচনা করেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আমরাও পিছিয়ে না গিয়ে সঠিক সময়ে, সঠিক আর সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারলে ঠিক সময়েই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হব।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *