১৩ জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বিপন্ন

১৩ জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বিপন্ন

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: জাতিসংঘের শিক্ষা-সংস্কৃতিবিষয়ক অঙ্গ ইউনেসকোর তথ্য বলছে, গড়ে প্রতি ১৪ দিনে বিশ্ব থেকে একটি করে মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের তিনটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা এখন নিজেরাই তাদের মাতৃভাষার কথা স্মরণ করতে পারে না। বিলুপ্ত হওয়ার পথে রয়েছে দুটি ভাষা। আর আটটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বেশ হুমকির মুখে রয়েছে।

এর পেছনের কারণ মূলত আর্থ-সামাজিক। ভাষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস (এসআইএল) বাংলাদেশের এক গবেষণায় উল্লিখিত তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তুলনামূলক স্বল্প পরিচিত জনগোষ্ঠীগুলো নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেয় এসআইএল বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৫টি স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর ভাষার ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যাপিং’ সম্পন্ন করেছে।

এসআইএল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কর্নেলিউশ টুডু কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা সব মিলিয়ে ২০টি নৃগোষ্ঠীর ভাষার ওপর গবেষণা চালাবেন। ১৫টি শেষ হয়েছে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য ও মূল লক্ষ্য হলো কম পরিচিত জনগোষ্ঠীর ভাষার প্রকৃত অবস্থা জানা, সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের অবগত করা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
কর্নেলিউশ টুডু বলেন, ভাষা সংরক্ষণের জন্য এসব জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থার উন্নতির পথ বের করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

গবেষণা পদ্ধতি
এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই জরিপে এক্সপ্যান্ডেড গ্রেডেড ইন্টারজেনারেশনাল ডিসরাপশন স্কেল বা ‘ইগিডস’ মানদণ্ড অনুসরণ করেছে।
এই মানদণ্ডে মোট ১০টি স্তর রয়েছে। যেসব ভাষা জাতীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহৃত হয় এবং সুরক্ষিত অবস্থানে আছে, সেসব ভাষা থাকে প্রথম থেকে তৃতীয় স্তরে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ভাষার ব্যবহার, সাহিত্য ও লিখিত রূপে ভাষার ব্যবহার থাকলে তা চতুর্থ ও পঞ্চম স্তরে থাকে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম স্তরে বয়স অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে ভাষার স্থানান্তর, যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারসহ আরো বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ভাষাটি কতটা সবল বা বিপন্ন তা বোঝা যায়।
ভাষার অবস্থা ও সংকটের তীব্রতা বোঝাতে ষষ্ঠ ও অষ্টম স্তরকে দুটি উপস্তরে ভাগ করা হয়েছে। ইগিডসের নবম ও দশম স্তরে ভাষাটি বিলুপ্ত বা মৃত কি না, তা জানা যায়। মূলত ৬(ক) স্তর পর্যন্ত ভাষাগুলো নিরাপদ আছে বলে ধরা হয়। ৬(খ) থেকে দশম স্তর পর্যন্ত কোনো ভাষা থাকার অর্থ হলো তা ঝুঁকিপূর্ণ, বিপন্ন বা বিলুপ্ত।
গুণগত এবং পরিমাণগত পদ্ধতির মিশ্রণে গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষণাকালে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে বসবাস ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপ, সাক্ষাৎকার, কেস স্টাডি ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষার বর্তমান অবস্থা, দৈনন্দিন জীবন ও শিক্ষাক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার, মাতৃভাষায় নতুন প্রজন্মের অভ্যস্ততার মতো বিষয়গুলো দেখা হয়েছে গবেষণায়।

হুমকির মুখে আট ভাষা
এই গবেষণায় ১৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা চিহ্নিত করে এগুলোর বর্তমান চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আটটি মাতৃভাষাই হুমকির মুখে রয়েছে। ইগিডস মানদণ্ড অনুসারে এই আট ভাষা রয়েছে ৬(খ) স্তরে। সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে এসব ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাড়াইক জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের চা-বাগান এলাকায় বাস করে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পাবনা ও সিরাজগঞ্জেও বাড়াইকদের বসবাস রয়েছে। এসআইএল বাংলাদেশ বলছে, দেশে সব মিলিয়ে বাড়াইকদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের চা-বাগান এবং উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বসবাসকারী গঞ্জু সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ হাজার। জয়পুরহাট ও দিনাজপুরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমের বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত মালো জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ হাজারের একটু বেশি।
মালো, বাড়াইক ও গঞ্জু সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত কথা বলতে ‘সাদ্রি’ ভাষা ব্যবহার করে। কিছু অঞ্চলে মালোরা বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে সাদ্রি ভাষা লিখলেও বাড়াইক ও গঞ্জুদের ক্ষেত্রে এসআইএল বাংলাদেশ তাদের গবেষণা এলাকায় সাদ্রি ভাষার লিখিত প্রচলন পায়নি।

উত্তর-পশ্চিমের জেলা ও সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানে প্রায় চার হাজার তেলি জনগোষ্ঠীর মানুষের বাস। দিনাজপুর, রংপুরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে বাস করে তুরি জনগোষ্ঠীর ১২ হাজার সদস্য। তেলি সম্প্রদায় ‘নাগরি’ ও তুরি সম্প্রদায়ের লোকেরা ‘খট্টা’ ভাষায় কথা বলে। উত্তর-পশ্চিমের জেলা এবং সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের চা-বাগানে বসবাস করে তিন হাজার ২৩৮টি মুসহর পরিবার। এই জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হলো ‘দেশওয়ালি’ ও ‘নাগরি’। এই সম্প্রদায়গুলোর মাতৃভাষার অবস্থান ইগিডস মাপকাঠি অনুযায়ী ষষ্ঠ স্তরে দ্বিতীয় ভাগে (৬খ) পড়ে, যার অর্থ এগুলো হুমকির সম্মুখীন। একই স্তরের অন্তর্ভুক্ত হলো কন্দ সম্প্রদায়ের ‘কুই’ ও ‘উড়িয়া’ ভাষা এবং ভূমিজ সম্প্রদায়ের ‘ভূমিজ’ ভাষা।
এসআইএলের গবেষণা বলছে, সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীগুলোর বয়স্ক ও প্রবীণরাও সার্বক্ষণিকভাবে এসব ভাষা নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করেন না। জীবন-জীবিকার কাজে অন্য প্রভাবশালী ভাষা ব্যবহারকারীদের মাঝে নিজের ভাষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন তাঁরা। ব্যবহার না থাকায় তরুণ ও শিশুদের মধ্যে মাতৃভাষা চর্চা বা শেখার চেয়ে দ্বিতীয় ভাষা শেখার আগ্রহ বেশি।
গবেষকদলের সহকারী গবেষক স্বাক্ষর রেইজ গমেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গবেষণায় আমরা যে চিত্র দেখেছি তা কিছু ভাষার জন্য উদ্বেগজনক। সরকারি বা বেসরকারিভাবে এখনই এই ভাষাগুলো সংরক্ষণের পদক্ষেপ না নিলে তা চিরকালের জন্য হারিয়ে যেতে পারে।’

নিরাপদ অবস্থানে লালেংথার ও বানাই ভাষা
সিলেটের চারটি উপজেলায় বসবাসকারী পাত্র জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা প্রায় চার হাজার। অন্যদিকে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহে বানাই জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫৯৩ জনের বসবাস। ইগিডসের মাপকাঠি অনুযায়ী, এই দুই গোষ্ঠীর ভাষা ষষ্ঠ স্তরের প্রথম ভাগে (৬ক) শ্রেণিভুক্ত করেছে এসআইএল। অর্থাৎ এই দুটি ভাষা বলিষ্ঠ অবস্থায় রয়েছে। পাত্র ও বানাই সম্প্রদায়ের প্রবীণ থেকে শিশু প্রত্যেকে নিজের মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে এবং যোগাযোগ করতে পারে। পাত্রদের মাতৃভাষা ‘লালেংথার’-র নিজস্ব বর্ণমালা না থাকলেও বাংলা হরফ ব্যবহার করে তারা নিজেদের ভাষা লিখে থাকে।
প্রায় বিলুপ্ত খাট্টালি ও ফার্সি ভাষা
ইগিডসের মাপকাঠি অনুযায়ী প্রায় বিলুপ্ত অর্থাৎ অষ্টম স্তরের দ্বিতীয় ভাগে (৮খ) পড়েছে রাজোয়ার সম্প্রদায়ের ‘খাট্টালি’ ভাষা ও খাড়িয়া সম্প্রদায়ের ‘ফার্সি’ ভাষা। খাড়িয়ারা বাস করে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের চা-বাগানে। এই জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা চার হাজার ২৯০ জন। উত্তর-পশ্চিমের জেলা ও সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানে বাস করে ছয় হাজার ৭৪৫ রাজোয়ার জনগোষ্ঠীর লোক।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, রাজোয়ার ও খাড়িয়া সম্প্রদায়ে শুধু প্রবীণদের মধ্যেই মাতৃভাষার ব্যবহার দেখা যায়। ভবিষৎ প্রজন্মের মধ্যে তাদের ভাষার স্থানান্তর হচ্ছে না।

বিলুপ্ত বাগদি, হুদি ও ভূইমালিদের ভাষা
ইগিডস মানদণ্ডে থাকা সবচেয়ে নিচের স্তর হলো দশম স্তর। এই স্তরে বিলুপ্ত বা মৃত ভাষাগুলোর ঠাঁই হয়। এসআইএল বাংলাদেশের গবেষণায়, বাগদি, হুদি ও ভূইমালি সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই স্তরে। এই তিন সম্প্রদায়ের লোকেরা এখন বাংলায় কথা বলে। নিজেদের মাতৃভাষা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। এ বিষয়ে লিখিত কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি। তবে হুদি সম্প্রদায়ের মানুষ কিছু কিছু শব্দ তাদের নিজেদের ভাষা বলে স্মরণ করতে পারে।
গবেষণা বলছে, মৌখিক চর্চার অভাব, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তর না হওয়া, সাহিত্যে ও লিখিত রূপে সংরক্ষণ না হওয়ায় ভাষা বিপন্ন ও বিলুপ্ত হচ্ছে। সবল ও বিপন্নপ্রায় ভাষাগুলো সংরক্ষণের জন্য এখনই বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে গবেষকদল। কেননা সবল ভাষাগুলোকে শক্তিশালী ভাষায় পরিণত না করলে এবং বিপন্ন ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা না করলে হারিয়ে যেতে পারে এসব ভাষা।

বিপন্নতার কারণ দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবস্থা
এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গবেষণা দলের র‌্যাপিড জরিপে ১৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটি সাধারণ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় ভাষা বিপন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে আর্থিক ও সামাজিকভাবে পশ্চাত্পদ থাকার বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
গবেষণার অংশ ১৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রত্যেকের অর্থনৈতিক চিত্র প্রায় একই রকম। প্রতিটি সম্প্রদায়েই ৮০ থেকে ৮৭ শতাংশ পরিবারেরই দৈনিক আয় মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকা। সব কিছু মিলিয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও নিজস্বতা কোনো গুরুত্ব পায় না তাদের কাছে। দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা তাদের মাতৃভাষাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ১৫টি সম্প্রদায়ের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব জমি নেই। তারা সরকারি খাসজমি, অন্যের জমি, ভাড়া বাসায় বসবাস করে। চা-বাগানে বসবাসকারীদের ৯০ শতাংশ কম্পানির জমিতে থাকে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *