বিশ্বশান্তির অপরিহার্য অনুষঙ্গ

বিশ্বশান্তির অপরিহার্য অনুষঙ্গ

ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন: প্রতি বছর ফেব্রæয়ারির প্রথম সপ্তাহ উদযাপিত হয় জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি সপ্তাহ । এ সপ্তাহ আমাদের ক্রমবর্ধমান আন্তসংযুক্ত বিশ্বে গভীর তাৎপর্য বহন করে। ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত এ সপ্তাহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধর্মের, ঐতিহ্যের অনুসারীদের মধ্যে শান্তি, বোঝাপড়া এবং সহযোগিতার বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল প্রচার করে থাকে। পশ্চিম সাহারার অস্থিরতা, দক্ষিণ থাইল্যান্ডের জাতিগত সংঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত এবং রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করার এহেন অস্থির পৃথিবীতে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি অপরিহার্যতা আরও অপরিহার্য হয়ে উঠছে। সংঘাত ও বিবাদের বিপরীতে আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহর জাতিসংঘে সম্প্রীতি এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিশ্ব আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি সপ্তাহ শান্তি ও স্থিতিশীলতা তৈরিতে ধর্মীয় স¤প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়। সংলাপ এবং সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ (রেজল্যুশন অ/৬৫/৫) আন্তধর্মীয় সম্পৃক্ততাকে সংঘাত প্রতিরোধ, সমাধান এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।


জাতিসংঘের পরামর্শে সরকার, ধর্মীয় সংগঠন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং সবাইকে একত্রিত করে সপ্তাহজুড়ে অনেক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সত্যিকার অর্থে সম্প্রীতির এসব চেষ্টা বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বৃহত্তর বোঝাপড়া এবং সহযোগিতার লক্ষ্যে আন্তধর্মীয় কথোপকথন, পরিষেবা, শান্তিবৃদ্ধি কর্মশালা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং স¤প্রদায় পরিষেবা প্রকল্পগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। ওয়ার্ল্ড ইন্টারফেইথ হারমনি উইক ধর্মীয় ঐতিহ্যের মাধ্যমে লালিত মূল্যবোধগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। শান্তি প্রচেষ্টায় অভিন্নতার ওপর জোর দিয়ে, সাপ্তাহিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের বিপরীতে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি করে, পার্থক্যকে অতিক্রম করে বোঝাপড়া ও সহানুভ‚তির সেতুবন্ধন তৈরি করে।
আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির সফলতার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো শিক্ষা। শিক্ষা সংলাপ এবং সহযোগিতার মাধ্যমে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং চরমপন্থার মূল কারণগুলো মোকাবিলা করার জন্য একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করা জরুরি। সম্মানজনক কথোপকথন ও যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে, ব্যক্তি এবং সাম্প্রদায়সমূহ সমাজে প্রচলিত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতে পারে, ভুল ধারণাগুলো দূর করতে পারে এবং ধর্মীয় সীমানার মধ্য থেকেই পারস্পরিক সহানুভ‚তির বন্ধন তৈরি করতে পারে। বিশ্ব আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি সপ্তাহ অন্তর্ভুক্তিমূলক, যা শান্তি ও সম্প্রীতি প্রচারে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ সব ধারার লোকদের অন্তর্ভুক্ত করতে ধর্মীয় সামগ্রিক কল্যাণের কাজে এগিয়ে যায়।


বর্তমানে চলমান বৈশ্বিক সংঘাতের বিপরীতে পারস্পরিক সহমর্মিতার ভিত্তিতে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বোঝাপড়া এবং সহযোগিতার অনুস্মারক হিসেবে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি সপ্তাহ শুরু হয়েছে। কেবল ধর্মের বিভিন্নতার কারণে যখন কোনো মানুষ নির্যাতিত হয় অথবা সমাজে সংঘাত ও অশান্তি সৃষ্টি হয় তখন মানবতা ভ‚লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আমরা যদি প্রশ্ন রাখি, ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের কী দিয়েছে? ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণে এ মানবিক বিশ্বে সবার চোখের সামনে যে প্রায় ২৬ হাজার তাজা প্রাণ ঝরে পড়েছে, এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? আর রোহিঙ্গা সংকটের আজও তো কোনো সুরাহার লক্ষণ নেই! সত্যিকার অর্থে উল্লিখিত সংঘাতের সম্মুখীন অঞ্চলে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির নীতিগুলো বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আন্তধর্মীয় উদ্যোগ সংলাপ, সহানুভ‚তি এবং পারস্পরিক সম্মান বৃদ্ধির মাধ্যমে পুনর্মিলন এবং টেকসই শান্তিকে উন্নীত করে। ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পটভ‚মি নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির অন্তর্নিহিত মর্যাদাকে স্বীকার করা, দ্ব›দ্ব নিরসনে এবং আরও ন্যায়সংগত সমাজ গঠনের জন্য সর্বোত্তম পন্থা। বিশ্ব আন্তধমীয় সম্প্রীতি সপ্তাহের সাফল্য কামনা করি।
আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় যখন জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তখন জাতিসংঘের এবং বিশ্ব ধর্ম সংসদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তধর্মীয় সংলাপ এবং সহযোগিতার প্রচারে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে। এই প্রচেষ্টাগুলো বিশ্বব্যাপী শান্তি ও পুনর্মিলনের জন্য একটি শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে, যা বর্তমান হতাশার মাঝেও ক্ষীণ আলোকচ্ছটা দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও হাজার হাজার বছর ধরে সব ধর্ম, বিশ্বাস ও পথের মানুষ একসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করে আসছে। ইসলামে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষা ও নীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। ইসলাম, মুসলিম এবং বিভিন্ন ধর্মের ঐতিহ্যের ব্যক্তিদের মধ্যে শান্তি, সহানুভ‚তি এবং বোঝাপড়ার মূল্যকে জোর দেয়। কুরআনের সুরা আল হুজুরাতে (৪৯:১৩) এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদের পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।’ এই আয়াতে মানবতার মধ্যে বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি ও উপলব্ধি করার, বিভিন্ন পটভ‚মির মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার ওপর জোর দেয়। তাই সব ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।


বিশ্ব আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি সপ্তাহ বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আশাকে মূর্ত করে, আমাদের মানবতা, শান্তি ও বোঝাপড়ার বন্ধন গড়ে তোলার সম্মিলিত দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি সংলাপ, সহানুভ‚তি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে আরও শান্তিপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্বের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। সত্যিকার সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তথা শান্তিপূর্ণ পৃথিবী রচনায় ইন্টারফেইথ কার্যক্রম অনেকটাই আশার আলো দেখাচ্ছে। আশা করি ২০২৪ সালের ইন্টারফেইফ উইক আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টিকে আরও কার্যকরভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *