সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টা মেলে

সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টা মেলে

মাহমুদ আহমদ: মানুষ হিসাবে আল্লাহ পাকের কাছে সবাই সমান। কার ধর্ম কী তা পরের বিষয়, কেননা সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহ পাকের পরিবারভুক্ত। কেউ বিপদে পড়লে আরেকজন তাকে উদ্ধার করবে এটাই ধর্মের শিক্ষা। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রতি, এমনকি অপরাপর জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শন করাই হচ্ছে ধর্ম।
হাদিস গ্রন্থাবলি থেকে আমরা জানতে পারি, একজন নারী এ কারণে নরকাগ্নিতে প্রবেশ করেছে যে, একটি বিড়ালকে সে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রেখেছিল। অপরদিকে এক ব্যক্তি পিপাসার্ত একটি কুকুরকে পানি পান করানোর ফলে বেহেশত লাভ করেছে। সৃষ্টির সেবা যে কত মহান কাজ, তা উল্লিখিত দুটি ঘটনা দ্বারা সহজে অনুমেয়। ধর্ম, মানুষের সুখ-শান্তি ও পথপ্রদর্শন এবং আলোর সন্ধান দেওয়ার জন্য। ধর্মের মৌলিক অংশ দুটি। প্রথমটি হলো আল্লাহর প্রতি মানুষের কর্তব্য। নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি। আল্লাহর গুণ প্রকাশ, মহিমা কীর্তন ও তার পবিত্রতা ঘোষণা, তা আল্লাহর নির্দেশিত যে নিয়মেই হোক না কেন, তা মৌখিকভাবে প্রকাশ, আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাস এবং কার্যত প্রকাশ করলে সাধারণত আল্লাহর হক আদায় হয়। দ্বিতীয়টি হলো মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য। আল্লাহ যা আদেশ দিয়েছেন তা পালনে মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারে।
মানুষের প্রতি মানুষের করণীয় যা আছে তা পালনে বান্দার হক আদায় হয়। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে ভালোবাসে, জীবন ধারণের জন্য একে অপরের প্রতি নির্ভর করে। একা কেউই তার সম্পূর্ণ প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ করতে পারে না। একে অপরের সহায়তা করবে এবং করে থাকে এটাই স্বাভাবিক। কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির কেবল স্তূপীকৃত সম্পদ থাকলেই তার জন্য মহাপ্রাসাদ গড়ে উঠবে না। সেজন্য তাকে রাজমিস্ত্রি থেকে শুরু করে সাধারণ মজুরের প্রতি নির্ভর করতে হয়। তাই কাউকে ছোট বা হেয় করারও শিক্ষা ইসলামে নেই।
আমরা বিভিন্নভাবে বান্দার হক আদায় করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা যাদের ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তারা অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে পারি। আবার যাদের জ্ঞান দিয়েছেন, কিন্তু ধনসম্পদ দেননি, তারাও পারেন মানবসেবা করতে। দেখা যায়, গরিব ছেলেরা লেখাপড়া করতে বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। আবার প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ার সামর্থ্যও তাদের হয় না। সম্পদশালীরা তাদের অর্থের দ্বারা এবং শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের বিদ্যার দ্বারা তাদের সাহায্য করতে পারেন। এক কথায়, বক্তা তার বক্তৃতার মাধ্যমে, লেখক তার লেখার মাধ্যমে, বিত্তশালীরা তার সম্পদ দ্বারা, বুদ্ধিমান তার বুদ্ধির দ্বারা, জ্ঞানী তার জ্ঞান দ্বারা, স্বাস্থ্যবান তার শক্তির দ্বারা সমাজের সেবা করতে পারে। আমরা সবাই যদি নিজ নিজ স্থানে অন্যকে আলোর দিকে পথ দেখাই, সুপথের দিকে আহ্বান করি, তাহলে অনেক অশুভ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারব। বিদ্যার দ্বারা জনসেবা করলে বিদ্যা কমে যায় না বরং তার বৃদ্ধি ঘটে, প্রদীপ্ত হয়ে উঠে। আল্লাহর প্রতিটি দান মানুষের উন্নতির জন্য। প্রয়োজন শুধু পরস্পর সহযোগিতার।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ মানুষকে স্বার্থপর ও কৃপণ হতে নিষেধ করেছেন। তাই মূল্য ছাড়া কোনো কাজেই হাত দেব না বলে যারা প্রতিজ্ঞা করে, তাদের চিন্তা করে দেখা উচিত। অনেক সময় পথে-ঘাটে কলা বা আমের খোসা ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আবার ওইগুলোতে পা পিছলিয়ে ধরাশায়ী হতে, এমনকি হাত-পা ভাঙতেও দেখা গেছে। একটু কষ্ট স্বীকার করলে মানুষ পথ-ঘাট পরিষ্কার রেখে এ প্রকারের দুর্ঘটনা থেকে রেহাই লাভ করতে পারে। আমরা যাকে ভালোবাসী তার দুঃখ সহ্য করতে পারি না। মানুষ যদি বাস্তবিক মানুষকে ভালোবেসে থাকে তবে সবার ব্যথায় ব্যথিত হবে ও সবার দুঃখে দুঃখিত হবে এটাই সত্য। আজ ফিলিস্তিনিরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, তাদের জন্য আমরা কি কিছুই করতে পারি না? কিছুই না করতে পারলেও দোয়া তো করতে পারি। আসুন, কমপক্ষে সেজদায় তাদের জন্য ক্রন্দন হৃদয়ে দোয়া করি, আল্লাহপাক যেন তাদের কষ্ট দূর করেন।
কারও শরীরের কোনো অঙ্গ যদি আঘাত পায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে তবে সে কি আনন্দ পায়? বরং কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সমাজের এক অংশ আক্রান্ত, ক্ষুধার্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, বস্ত্রহীন হলে অপর অংশ তাদের সাহায্যার্থে প্রাণঢালা সাহায্য করবে। তবেই সুষ্ঠু ও বলিষ্ঠ জাতি গড়ে উঠবে। আত্মতুষ্টির জন্যও সৃষ্টি সেবার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রত্যহ সৃষ্টি সেবার কত সুযোগই না পাওয়া যায়, যেগুলো পালনের জন্য আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু আমরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করি না বরং অবহেলা করি, অবজ্ঞার চোখে দেখি। স্রষ্টার সৃষ্টিকে অবহেলা করে স্রষ্টাকে তুষ্ট করা যায় না। মানুষের দুঃখ ও ব্যথায় ব্যথিত হয়ে, তাকে মনে প্রাণে অনুভব করে, তার প্রতিকার করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই হচ্ছে ধর্মের শিক্ষা। প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বের প্রতি সজাগ থাকে তবেই সৃষ্টি সেবার মহান এক সংঘ গড়ে উঠবে। অপরের প্রতি অনুকম্পা, সহানুভূতি, উদারতা ও দয়া প্রদর্শন করা আজ আমাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দয়া হতে দানশীলতার সৃষ্টি হয়। দানশীলতা ও সেবা করা মানবচরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য আর নির্দয় ব্যক্তি পাষাণবৎ। অপরের অশ্রু দর্শনে যার হৃদয় বিগলিত হয় না, সে জনসেবার দাবি করতে পারে বটে, কিন্তু কার্যত: কোনো উপকারই করতে পারে না। দুঃখীর দুঃখমোচন, বিপন্নকে উদ্ধার, শোকাতুরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা সৃষ্টি সেবার অন্তর্ভুক্ত। লোক দেখানো দয়া, দান, উপাসনাকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। কর্তব্যানুসারে জনসেবা করতে হবে প্রকাশ্যে ও গোপনে। তবে এতে বিনয় অবলম্বনই শ্রেয়।
সব ধর্মই মানবসেবার কাজকে পুণ্য বলে আখ্যায়িত করেছে। সেবার উৎসাহ না থাকলে অন্ধ, খঞ্জ বধিররা করাল গ্রাসে নিপতিত হতো। মানবসেবায় মন উদার হয়। এতে আনন্দ লাভ করা যায়।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *