বাঙালির মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

বাঙালির মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

হারুন হাবীব: একাত্তরের জাতীয় রণাঙ্গনের মানুষ যারা, তারা সবাই স্মৃতিকাতর হই প্রতি ডিসেম্বরে। মনে পড়ে, অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় অনুচরদের তাড়া করে একের পর এক গ্রামগঞ্জ ও শহর মুক্ত করতে থাকে মুক্তিবাহিনী। যে হানাদার সেনারা এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও ‘পিস কমিটি’র সদস্যরা ৯টি মাস ধরে সারা দেশে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতন ও লুণ্ঠন-রাহাজানি চালিয়েছে, তারা দিশাহারা হয়ে পরাজয়ের দিন গুনতে থাকে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ ও নিষ্ঠুরতার দাবানল শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
নিরুপায় মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। গোটা ভারতে মোট ৮০০ শরণার্থী শিবির খোলা হয়। সর্বমোট এক কোটি মানুষ দেশান্তরিত হয়, আশ্রয় নেয় চার ভারতীয় রাজ্যে। এরপর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের মাটি ও মানুষ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে।
পাকিস্তানি গণহত্যার মাত্র দুই দিন পর, ২৭ মার্চ ১৯৭১ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বাংলাদেশসংক্রান্ত সর্বপ্রথম বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যা ঘটে চলেছে, তা কেবল পূর্ববঙ্গের মাটিতে আন্দোলন দমানো নয়, কার্যত তা নিরস্ত্র মানুষকে ট্যাংক দিয়ে পিষে ফেলার এক নির্মমতা।’ ৩১ মার্চ ১৯৭১ ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভা বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে এক সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করে পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নির্বিচার অত্যাচারের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। সেই প্রস্তাবে সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশের সংগ্রামরত মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা হয়।
এরপর শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৯ মাস পর আসে আরেক ঐতিহাসিক দিন। সোমবার, ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দিনটির প্রেক্ষাপট এ রকম: মুক্তিবাহিনীর লাগাতার আক্রমণ নভেম্বরের শুরুতেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী পর্যুদস্ত হতে থাকে। এর মধ্যে আসে ৩ ডিসেম্বর।
বাংলাদেশ থেকে নজর সরাতে ভারতের পশ্চিম অংশে ব্যাপক হামলা চালায় পাকিস্তান। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারত। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশের যুদ্ধ আজ থেকে ভারতেরও যুদ্ধ।’ ফলে গড়ে ওঠে দুই দেশের যৌথ সামরিক কমান্ড। মুক্তি ও মিত্র বাহিনী একযোগে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। ঠিক তার দুই দিন পর বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের বহুল তাৎপর্যময় সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করেন সেদিনকার ভারত নেত্রী।
৬ ডিসেম্বর দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করে ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা তড়িঘড়ি বা আবেগপ্রবণ হয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ এবং গণমানুষের সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রাম দেখে আমাদের বিলক্ষণ মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকে আর কখনোই নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে না পাকিস্তান। শ্রীমতী গান্ধীর বক্তব্য শেষ হতে না হতেই জনপ্রতিনিধিরা ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলাদেশ’ বলে হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠেন। সবাই একযোগে নতুন রাষ্ট্রকে অভিনন্দিত করেন।
৬ ডিসেম্বর, একই দিন, হিমালয় রাষ্ট্র ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তবে ভারতের স্বীকৃতিটির বিষয়টি ছিল সমূহ তাৎপর্যপূর্ণ। যে ভারত এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যে ভারত মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র-গোলাবারুদ জুগিয়ে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছে, এমনকি পাকিস্তান, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিরোধের মুখেও বাংলাদেশের পাশ থেকে সরে দাঁড়ায়নি, সেই ভারতের স্বীকৃতির ব্যাপারটি ছিল ইতিহাসের বড় আশীর্বাদ। এই স্বীকৃতি, পাকিস্তানকে এতই ক্ষুব্ধ করে যে দেশটি ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। বলাবাহুল্য, ভারতীয় স্বীকৃতির তিলক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অবধারিত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়।
পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক সদস্যের করতালির মধ্য দিয়ে ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন : প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক বীরত্বপূর্ণ নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামে আমাদের সহানুভূতি থাকা উচিত এবং এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বীকৃতির ব্যাপারে আমরা মোটেও তড়িঘড়ি করিনি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী একই দিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লিখিতভাবে ভারতের স্বীকৃতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বীকৃতি একটি মানবিক সত্যের স্বীকৃতি মাত্র। তবে ভারতের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত মোটেও ছোট বিষয় ছিল না।’ তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অন্তর থেকে শুভেচ্ছা জানান, বাংলাদেশের গণমানুষ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দিত করেন।
দৃশ্যতই ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে যৌথবাহিনী একের পর এক অঞ্চল দখল করে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে থাকে। ঢাকায় পরিপূর্ণভাবে অবরুদ্ধ হয় পাকিস্তানি বাহিনী। মিত্রবাহিনীর যুগপৎ আক্রমণে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর প্রতিটি যুদ্ধবিমান বিনষ্ট হয়। আত্মসমর্পণ ছাড়া পাকিস্তানের কাছে আর কোনো পথ খোলা থাকে না। ঠিক এ সময়ে দিল্লির মার্কিন দূতবাসের মাধ্যমে পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির আরজি পৌঁছে জেনারেল মানেক শর কাছে, কিন্তু ভারত যুদ্ধবিরতি মানতে রাজি হয়নি। বরং সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছে: যুদ্ধবিরতি নয়, হতে হবে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং অবিলম্বে। সেই আত্মসমর্পণ হতে হবে প্রকাশ্যে, যাতে সবাই দেখতে পায়।
এ সময় আরো একটি ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালিতে জাতিসংঘে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই-নিশ্চিত আত্মসমর্পণ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা, যুক্তরাষ্ট্রের লজ্জা নিবারণ করা। কিন্তু সেদিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন পর পর ভেটো প্রয়োগ করে প্রস্তাবটি অকেজো করে দেয়।
সব চেষ্টা বিফলে গেলে পাকিস্তান উপায়হীন হয়ে পড়ে। এরপর আসে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী নতজানু হয় সেই রমনার উদ্যানে, যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ডাক দিয়েছিলেন। ৯৩ হাজার হানাদার পরাজিত সেনা নিয়ে মুক্ত ঢাকায় হাজার হাজার মানুষের আকাশ ফাটানো জয় বাংলা ধ্বনির মধ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন জেনারেল নিয়াজি। হাজারো বাঙালি জে. অরোরা এবং মিত্রবাহিনীর সদস্যদের জড়িয়ে ধরেন। এই আত্মসমর্পণটি ছিল বিশ্বের একমাত্র প্রকাশ্য আত্মসমর্পণ, যা ঠেকাতে গিয়েও ব্যর্থ হয় পাকিস্তান।
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১। কলকাতা থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা স্বদেশে ফেরেন। ঢাকা তখন উল্লাসমুখর নগরী। অপেক্ষমাণ হাজার হাজার মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস পর ঢাকা নগরী এক নির্ভয় প্রাণে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ মুক্তি ও মিত্র বাহিনীকে বীরোচিত সংবর্ধনা জানায়। সর্বত্র জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় ইন্দিরা ধ্বনি ওঠে। এপ্রিলের এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরে মেহেরপুরের আম্রকুঞ্জে স্বাধীনতার যে তামস তপস্যা শুরু হয়েছিল, ডিসেম্বরের সূর্যোকরোজ্জ্বল অপরাহ্ণে বুড়িগঙ্গার তীরে সে মুক্তিযজ্ঞের শেষ আহুতি পড়ে। স্থায়ী হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এরপর দ্রুত আসতে থাকে বিশ্বস্বীকৃতি। প্রথমে পূর্ব জার্মানি, এরপর পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, বার্মা, নেপাল, বার্বাডোস, যুগোস্লাভিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকাস্লোভাকিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ।
কিন্তু বিজয়ের সেই মহা-আনন্দের মধ্যে গভীর বেদনা হয়ে ফিরে আসে ১৬ ডিসেম্বরের আগের কয়েকটি দিনের ঘটনা ও স্মৃতি। পরাজয় নিশ্চিত জেনে, পাকিস্তানি সেনানায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করে, ভয়ংকর এক হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা তৈরি করেছিল আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর শীর্ষ নেতারা। জাতির মেধা ও মননকে ধ্বংস করার সেই নীলনকশার বলি হয়েছিলেন সেদিন আমাদের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা- দার্শনিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বুদ্ধিবৃত্তির শীর্ষ বাঙালিরা।
ভয়াবহ এই হত্যাযজ্ঞের হৃদয়বিদারক বর্ণনা জানা গেছে কেবল ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর। দুমড়ানো, মোচড়ানো, ক্ষতবিক্ষত শত শত লাশ পাওয়া গেছে রায়েরবাজার, শিয়ালবাড়ী, মিরপুরসহ ঢাকার নানা বধ্যভূমিতে। দেশি ও বিদেশি নানা অনুসন্ধানে জানা গেছে, একমাত্র ঢাকা শহরেই ১৪ ডিসেম্বর প্রায় ২০০ শীর্ষ বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্মম পন্থায় হত্যা করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশকে পরিণত করা হয়েছিল বিরাট এক বধ্যভূমিতে, যার বিবরণ আছে প্রায় সারা বিশ্বেই। গবেষক রবার্ট পাইন তাঁর ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসের এক সেনা-বৈঠকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান, ‘ওদের তিন মিলিয়নকে খতম করে দাও, দেখবে বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খাবার নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।’
রবার্ট পাইন লেখেন, ‘কিন্তু এটা ছিল কেবলই শুরু। এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার অর্ধেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং কেবল ঢাকায়ই কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামেরও বেশিরভাগ মানুষ পালিয়ে যায়। বলতে গেলে গোটা দেশেই মানুষ পালাতে থাকে প্রাণ ভয়ে।’
নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দয় আগ্রাসনটি অগ্রসর হয় মূলত লিঙ্গভিত্তিক গণহত্যার রূপ নিয়ে। খ্যাতিমান সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ভাষ্য মতে, ‘এই গণহত্যার মূল টার্গেট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ, বাঙালি প্যারামিলিটারি আনসার এবং মুজাহিদ, হিন্দু, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক, ছাত্র, বিশেষত যারা প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিতে পারে। এরপর বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যেমন- অধ্যাপক, শিক্ষক-এঁরা।’
গবেষক আর জে রুমেল তাঁর ‘ডেথ বাই গভর্নমেন্ট’ বইয়ে লেখেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা বেছে বেছে তরুণদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এসব ছেলের দেহ কখনো পাওয়া যেত মাঠে, নদীর পানিতে অথবা কোনো আর্মি ক্যাম্পের পাশে।’ নাৎসিরা যেভাবে ইহুদি পুরুষদের বর্বরভাবে হত্যা করেছে, সেই রীতির পুনরাবৃত্তির কথা উল্লেখ করেছেন রুমেল।
ঢাকার চারদিক ঘিরে এক ভয়ংকর মৃত্যু উপত্যকা সৃষ্টি করা হয়েছিল। রবার্ট পাইনের ভাষায়: শুধু হত্যার পদ্ধতি নয়, মৃত্যুর পর এসব হতভাগ্য মানুষের লাশ গুম করা হতো, ফেলে দেওয়া হতো নদীতে, জলাভূমিতে। বিদেশি সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, এসব মানুষের বেশিরভাগকেই একসঙ্গে দড়িতে বেঁধে গুলি করে বা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে নদীতে ফেলা হতো। কারণ এরা বাঙালি, বাংলা ভাষায় কথা বলে। ঠিক একই ধরনের গণহত্যার নারকীয় পদ্ধতি ছিল আর্মেনিয়া এবং ১৯৩৭ সালের নানজিং গণহত্যার বিবরণে।
১৯৭১ সালের নারকীয় ঘটনাবলিতে দেখা যায় বাঙালি মেয়েদের ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে যততত্র। শুধু ধর্ষণ নয়, তাদের বহুসংখ্যককেই হত্যা করা হয়েছে। একাত্তরের নারী নির্যাতনের ওপর বহুলালোচিত গ্রন্থ ‘এগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন-উইমেন অ্যান্ড রেপ’ গ্রন্থে আন্তর্জাতিক গবেষক সুজান ব্রাউনমিলার বাঙালি নারী নির্যাতনের সঙ্গে জাপানি সেনাদের দ্বারা নানজিং ও জার্মানদের হাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় সংঘটিত ঘটনাবলির তুলনা করেছেন। তাঁর ভাষ্য মতে, সর্বমোট চার লাখের মতো নারী পাকিস্তানিদের হাতে ধর্ষিত হয়েছেন ৯ মাসে। রুয়ান্ডার গণহত্যায় আট লাখ মানুষ মারা গেছে, ইন্দোনেশিয়ায় মারা গেছে প্রায় ১৫ লাখ। কিন্তু বাংলাদেশে তার চেয়ে অনেক বেশি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *