যক্ষার গবেষণায় বৈশ্বিক স্বীকৃতি

যক্ষার গবেষণায় বৈশ্বিক স্বীকৃতি

পিন্টু রঞ্জন অর্ক: তিন দশক ধরে যক্ষা নিয়ে গবেষণা করছেন ড. সায়েরা বানু। তাঁর হাত ধরেই আইসিডিডিআর,বিতে যক্ষা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর অনেক গবেষণার ফলাফল গ্রহণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার। দ্য ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সের ২০২৪ সালের ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
তখন মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে যক্ষা রোগীর জন্য বিশেষায়িত ওয়ার্ড ছিল। সাধারণত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের মধ্যে যক্ষার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ফলে এই মানুষগুলোকে আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দেওয়া জরুরি। সেই কাজটি তখন করেছিলেন ড. আসিফ মুজতবা মাহমুদ ও তাঁর দল।
মা তাজকেরা বানুর স্বপ্নপূরণে চিকিৎসক হিসেবে মানবসেবার পথ বেছে নেন ড. সায়েরা বানু। এইচএসসির পর ভর্তি হন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। এমবিবিএস পাস করলেন ১৯৮৯ সালে। মায়ের ইচ্ছায় ইন্টার্নশিপের পর গাইনিকোলজিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন বারডেমে। অবশ্য মাসখানেক পরেই বারডেম অধ্যায়ের ইতি ঘটেছিল।
বারডেমে কাজের সময় তরুণদের জন্য আইসিডিডিআর,বি থেকে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া রিসার্চ ফেলোশিপের কথা জানতে পারেন। এজন্য পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। সেই পরীক্ষায় প্রথম হলেন সায়েরা বানু।
রিসার্চ ফেলো হিসেবে একটি প্রকল্পে যোগদান করলেন সাত হাজার টাকা বেতনে ১৯৯১ সালে। পরের বছরেই চলে গেলেন জাপানের ইউনিভার্সিটি অব সুকুবায় মাস্টার্স ইন মেডিক্যাল সায়েন্স পড়তে।
জাপান থেকে দেশে ফেরার পর ভাবছিলেন আইসিডিডিআর,বিতে নতুন কী করা যায়। তত দিনে ফরাসি সরকারের সঙ্গে চুক্তি হলো আইসিডিডিআরবির। এর মাধ্যমে দেশের একমাত্র গবেষক হিসেবে প্রতিশ্রুতিশীল এই তরুণীর গবেষণার সুযোগ মিলল ফ্রান্সের বিখ্যাত পাস্তুর ইনস্টিটিউটে। তখন আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী বললেন, ‘পাস্তুরে মাইকোব্যাকটেরিওলজি নিয়ে পিএইচডির একটি সুযোগ আছে। তুমি যেতে পারো।’
যক্ষার জীবাণুর প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছিল পাস্তুর ইনস্টিটিউটে। করেছিলেন অধ্যাপক স্টুয়ার্ট কোল। তাঁর তত্ত্বাবধানে সেই ল্যাবেই কাজের সুযোগ পেলেন সায়েরা বানু। পিএইচডি না করেই পাস্তুরে সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। কারণ সেখানে সাধারণত পিএইচডি’র পর পোস্টডক করতে যান গবেষকরা। কিন্তু এর আগে আইসিডিডিআর,বিতে যক্ষা নিয়ে তেমন কোনো কাজ হতো না। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠল, আইসিডিডিআর,বি থেকে যক্ষা নিয়ে কেন পড়তে যাবে? অনেকের সংশয় ও দ্বিধা উপেক্ষা করে তখন ড. ফেরদৌসী কাদরী সাহস দিয়েছিলেন সায়েরা বানুকে।
অনেক কিছুর সাক্ষী তিনি
আইসিডিডিআর,বিতে যক্ষা নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৯৯ সালের দিকে। তখন জায়গার সমস্যাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিল। জাতীয় পর্যায়েও মাইকোব্যাকটেরিওলজি ল্যাব ছিল না। আইসিডিডিআর,বিতে তাঁর হাত ধরেই প্রথম যক্ষার গবেষণাগারের যাত্রা শুরু হলো। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন বলে অনেক ঝড়ঝাপটায় ছাতা ধরতে হয়েছে। কারণ দেশে কাজটি একেবারেই নতুন। ল্যাব নেই, এমনকি পরামর্শ দেওয়ার মতোও কেউ নেই। বাংলাদেশে যক্ষার জীবাণুর কালচার করার মতো সুবিধাও ছিল না।
তিনি বলেন, ‘তখন মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে যক্ষা রোগীর জন্য বিশেষায়িত ওয়ার্ড ছিল। সাধারণত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের মধ্যে যক্ষার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই মানুষগুলোকে আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দেওয়া জরুরি। সেই কাজটি তখন করছিল ড. আসিফ মুজতবা মাহমুদ ও তাঁর দল। নমুনা পরীক্ষার পর ওষুধে সেনসিটিভ বা রেজিস্ট্যান্স কি না, বিনা পয়সায় সেই পরীক্ষা আমি করে দিতাম।’
কাজের পরিধি বাড়লে আইসিডিডিআর,বির আটতলায় বড় পরিসরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বিএসএলটু প¬াস ল্যাব চালু করলেন। ল্যাবের ডিজাইন থেকে শুরু করে সব কিছু সায়েরা বানুকেই করতে হয়েছিল। অধ্যাপক স্টুয়ার্ট কোল এরপর দুইবার বাংলাদেশে আসেন তাঁর পিএইচডি গবেষকের ল্যাব ও কাজ দেখতে।
জেলেও গেলেন
না। কোনো অপরাধের শাস্তি ভোগের জন্য নয়। কয়েদিদের রোগ শনাক্তে। ২০০৫ সালে। তত দিনে তাঁর পিএইচডি শেষ হয়ে গেছে। যক্ষা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ড. বানুর মনে হলো, বন্দিদের হিসাবের বাইরে রাখলে চলবে না। তাঁর প্রস্তাবিত প্রকল্পে তহবিলও মিলল। পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তৎকালীন আইজি প্রিজনের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি জানালেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। সেখানেও গেলেন। মোটকথা, কাজটি নিয়ে লেগে ছিলেন। প্রায় বছরখানেক নানা দপ্তরে ঘোরাঘুরির পর অবশেষে কারাগারের অভ্যন্তরে কাজের অনুমতি পেলেন।
ড. সায়েরা বানু জানালেন, কারাগারে দুই ধরনের বন্দি আছে। এক. এরই মধ্যে ভেতরে আছে। দুই. প্রতিদিন নতুন ১০০ থেকে ২০০ বন্দি ঢুকত, যারা সবাই হয়তো প্রমাণিত অপরাধী নয়। আমদানি বলে একটি এলাকায় আগত বন্দিদের এক দিন রেখে পরে সেলে পাঠানো হতো।
সামগ্রিক চিত্রটি বোঝার জন্য তখন প্রবেশের সময় নতুন বন্দি এবং আলাদাভাবে ভেতরে থাকা বন্দিদের পরীক্ষা করত ড. সায়েরা বানু ও তাঁর গবেষকদল। যক্ষার উপসর্গ থাকা ব্যক্তির কফের নমুনা এনে আইসিডিডিআর,বির ল্যাবে পরীক্ষা করতেন। এতে সাধারণের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি রোগী পেলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে! ড. বানুসহ সবার সম্মিলিত উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে কারাগারে আক্রান্তের হার কমে এলো।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কাজ করেছেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে কয়েক লাখ বন্দিকে পরীক্ষার আওতায় এনেছেন। সেই ফলাফলের ভিত্তিতে পরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটের কারাগারেও কাজ করেছেন।
কারাগারে দীর্ঘদিনের সাজা খাটা বন্দিদের রাইটার বলে। এই রাইটারদের স্ক্রিনিং ও কিভাবে রোগীদের কাউন্সেলিং করতে হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিলেন। পরে সেই রাইটাররাই বন্দিদের স্ক্রিনিং করতেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চলে এলেও কাজটি যেন সচল থাকে, তাই এই মডেল নিয়ে এগিয়েছি। আমাদের এই মডেল পরে বেসরকারি সংস্থাগুলোও গ্রহণ করেছে।’
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম
২০০৭ সালের দিকে জাতীয় যক্ষা প্রাদুর্ভাব সমীক্ষায় সহনেতৃত্ব দিয়েছিলেন ড. সায়েরা বানু। সত্তরের দশকের শুরুতে দেশে এমন একটি সমীক্ষা হয়েছিল। ফলে প্রায় তিন দশক পর দেশে যক্ষার প্রাদুর্ভাব বোঝার জন্য এটি বেশ কাজে দিয়েছিল।
ড. বানুর নেতৃত্বে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স (এমডিআর) এবং ব্যাপকভাবে ড্রাগ প্রতিরোধী (এক্সডিআর) যক্ষা নিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গবেষণা হয়েছে ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। দেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষার প্রকৃত চিত্র বুঝতে সাহায্য করেছিল সেটি। এই গবেষণার অধীনে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষা শনাক্তকরণের জন্য প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এক্সপার্ট এমটিবি রিফ/অ্যাস চালু করেছিলেন তাঁরা।
সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ মডেল
সাম্প্রতিক হিসাবে দেশে বছরে প্রায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষায় আক্রান্ত হয়। তিন লাখের কিছু বেশি শনাক্ত করা যায়। শনাক্তের বাইরে থাকা প্রায় ৩১ শতাংশ রোগীকে বলা হয় মিসিং টিবি কেস। তাদের একটি বড় অংশ বেসরকারি খাতে চিকিৎসা নেয়। যক্ষা পরীক্ষার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি আছে; যেমন-জিন এক্সপার্ট, এটি বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালে নেই। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্টপ টিবি প্রগ্রামের অংশ হিসেবে ‘সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ মডেল’ বলে একটি প্রজেক্ট হাতে নিলেন ড. সায়েরা বানু। তিনি বলেন, ‘রোগীবান্ধব কয়েকটি সেন্টার বানাতে চাইলাম। একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করলাম। ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রেতাদেরও বোঝালাম। চিকিৎসকদেরও।’ ২০১৪ সালে এই সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ মডেল চালু করলেন। এখন ঢাকায় সাতটি, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে একটি করে এ ধরনের মোট ১০টি সেন্টার আছে। এই মডেলটি ন্যাশনাল টিবি কন্ট্রোল প্রগ্রামের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক প¬্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শিশুদের জন্য নতুন উপায়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে মোট যক্ষা রোগীর প্রায় ১০ শতাংশ শিশু। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৪ শতাংশের বেশি শিশুর যক্ষা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। গবেষণা করতে গিয়ে ড. বানু দেখলেন, বড়দের কফের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা গেলেও বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। কারণ তারা কফটা গিলে ফেলে। তখন শিশুদের মল পরীক্ষা করে এটি চিহ্নিত করা যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। শিশুর মল দিয়ে যক্ষার পরীক্ষা-নতুন ধরনের এই গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন ঈষরহরপধষ ওহভবপঃরড়ঁং উরংবধংবং জার্নালে। এটি পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের টিবি কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করল। শিশু যক্ষা ব্যবস্থাপনার জাতীয় গাইডলাইনে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া কাজটি এখন দেশব্যাপী চলছে। ড. বানু বললেন, ‘শিশু যক্ষা রোগী চিহ্নিত করার কাজটি অত সহজ নয়। ক্লিনিক্যাল ইভালুয়েশন দেখে তা বের করতে হয়। কিভাবে বাচ্চাদের যক্ষা নির্ণয় করা হবে-এ নিয়ে একটি ট্রেনিং মডেল ঠিক করলাম।’ এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, শিশু হাসপাতালসহ ৫০টির বেশি হাসপাতাল ও ১২০টির বেশি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে শিশুদের স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। তাঁর এই উদ্যোগের কারণে রাজশাহী, সিলেটসহ বেশ কিছু অঞ্চলে এখন মোট শিশু রোগীর ৬-৭ শতাংশ চিহ্নিত হচ্ছে।
রোগীর জন্য কিছু করতে চান
ড. সায়েরা বানুর জীবনের বড় সময় চলে গেছে যক্ষা নিয়ে কাজ করতে করতে। এখন প্রায় এক হাজারের বেশি গবেষক ও কর্মীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মৌলিক গবেষণার পাশাপাশি ড. বানু প্রশিক্ষণ, নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন এবং সরাসরি রোগী কিভাবে উপকৃত হবে, সেই কাজটি করেন। তিনি বলেন, ‘এটি এখন আমার প্যাশন হয়ে গেছে। সরাসরি রোগীদের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো বোধ করি। এটি গরিব মানুষদের বেশি আক্রান্ত করে। ফলে বৈশ্বিকভাবে এটি নিয়ে পর্যাপ্ত কাজ হয় বলে মনে হয় না। কভিডে কত ভ্যাকসিন এলো। যক্ষা নিয়ে সেই ধরনের ভ্যাকসিন নেই। আমি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সম্মেলনে যক্ষার টিকার জন্য ফান্ড বাড়ানোর প্রয়োজন নিয়ে কথা বলছি। জীবদ্দশায় যক্ষার টিকা দেখে যেতে চাই।’

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *