বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতে অভূতপূর্ব অর্জন

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতে অভূতপূর্ব অর্জন

ডা. শাহরিয়ার রোজেন: ২০২৩ সাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এ বছর স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। চলতি বছর বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো নিয়ে লিখেছেন কানাডার সেন্টার ফর রিসার্চ ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি অ্যানালিস্ট ডা. তৃষিতা সাহা বিশ্বাস ও কানাডার গভর্নমেন্ট অয আলবার্টার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং পরিচালক ডা. শাহরিয়ার রোজেন
রোগ নির্মূল: ২০২৩ সাল রোগ নির্মূলের জন্য একটি রেকর্ড বছর। এ বছর বিভিন্ন দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ। এ বছর বাংলাদেশেই কালাজ্বর এবং এলিফ্যান্টটিয়েসিস (গোদরোগ) একই সঙ্গে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া আজারবাইজান, তাজিকিস্তান এবং বেলিজ থেকে ম্যালেরিয়া রোগ এবং মালি, বেনিন এবং ইরাক থেকে ট্রাকোমা, যা কিনা অন্ধত্বের গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়েছে। ইজিপ্ট, যে দেশ দশ বছর আগেও বিশ্বের সর্বোচ্চ হেপাটাইটিস-সি সংক্রমণের জন্য পরিচিত ছিল, সেখানে হেপাটাইটিস নির্মূল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
ভ্যাকসিন প্রদান: ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৭২% মানুষ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের কমপক্ষে একটি ডোজ পেয়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ চলাকালে শিশুদের টিকাদানে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল, সেটি উল্লেখযোগ্যভাবে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ বছরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলো ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে নতুন এক ধরনের ভ্যাকসিন আবিষ্কার। ধারণা করা হয়, ভ্যাকসিনটি আফ্রিকান অঞ্চলের হাজার হাজার তরুণদের জীবন বাঁচাবে। এছাড়া ডেঙ্গু এবং মেনিনজাইটিস রোগ প্রতিরোধেও নতুন এক ধরনের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। আবার জরায়ুর ক্যানসার প্রতিরোধে ঐচঠ ভ্যাকসিন গ্রহণের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা দিয়েছে। চলতি বছর আরও ৩০টি দেশে এ ভ্যাকসিনটি নতুনভাবে চালু হয়েছে।
অসংক্রামক ও মানসিক রোগ হতে সুরক্ষা প্রদান: অসংক্রামক ও মানসিক রোগ প্রতিরোধে এ বছর বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা গিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭৪টি দেশে ইনডোর পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র এবং গণপরিবহনে সম্পূর্ণরূপে ধূমপানমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা ২০০৭ সালে ছিল মাত্র ১০টি। ভারত ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস আক্রান্ত ৭৫ মিলিয়ন ব্যক্তিকে স্ক্রিনিং করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ‘স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ ফর মেন্টাল হেলথ’ ২০১৯ সালে চালু হওয়ার পর থেকে এ বছর পর্যন্ত আরও ৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ উদ্যোগটি মূলত বিশ্বের ছয়টি দেশে চালু হয়েছে, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
জলবায়ু বিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন (কপ-টোয়েন্টিএইট): দুবাইয়ে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ-টুয়েন্টিএইট-এ একটি নতুন চুক্তির বিষয়ে সদস্য দেশগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে, যাতে প্রথমবার তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার জন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান হয়েছে। তবে অনেক দেশের দাবি অনুযায়ী একবারেই বাতিল না করে ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে নতুন চুক্তিতে।
প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন: চলতি বছর হিউম্যান রিপ্রোডাকশন প্রোগ্রামের (এইচআরপি) ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। এটি জাতিসংঘের একটি বিশেষ উদ্যোগ, যা বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। ২০২৩ প্রজনন স্বাস্থ্যের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে। এ বছর একটি ট্রায়াল প্রসবোত্তর রক্তপাতের কারণে মাতৃমৃত্যু হ্রাস করার জন্য বড় প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ। এছাড়া, সার্ভিকাল ক্যানসার নির্মূল করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। ধারণা করে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া আগামী ১০ বছরের মধ্যে এবং যুক্তরাজ্য ২০৪০ সালের মাঝে সার্ভিকাল ক্যানসার নির্মূলের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে।
টেলিমেডিসিনের ব্যবহার এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন: কোভিভ মহামারি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, তা হলো টেলিমেডিসিন। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই সহজলভ্য করে তুলেছে। এছাড়া, এবছর অও (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) রোগ নির্ণয়, ওষুধ আবিষ্কার এবং স্বাস্থ্যসেবায় এক নতুন বিপ্লব ঘটিয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা স্বাস্থ্যসেবায় এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আরও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখার আশা রাখতে পারি।
২০২৩ সালের অর্জন শুধু রোগের সঙ্গে লড়াই করা নয়, বরং এটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির এক আমূল পরিবর্তন এনেছে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া, স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বিনিয়োগ এবং বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা উৎসাহিত করার মাধ্যমে একটি টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব-এ লক্ষ্য নিয়েই ২০২৩-সমাপ্ত করে ২০২৪-এ আমরা পদার্পণ করতে যাচ্ছি।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *