মানবদেহে নিপাহর অক্সফোর্ডের টিকার পরীক্ষা শুরু

মানবদেহে নিপাহর অক্সফোর্ডের টিকার পরীক্ষা শুরু

পার্থ শঙ্কর সাহা ও মোছাব্বের হোসেন: প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসের টিকার মানবদেহে পরীক্ষা শুরু হয়েছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ টিকার নাম চ্যাডোক্স১ নিপাহ বি। চিকিৎসক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা এ প্রচেষ্টাকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। ক্ষয়ক্ষতির নিরিখে বিশ্বে এখন জলাতঙ্কের পরই ভয়ানক নিপাহ ভাইরাস। এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রায় ৭৫ ভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তবে জলাতঙ্কের টিকা আছে, নিপাহ ভাইরাসের কোনো টিকা নেই।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানডেমিক সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট এ টিকা উদ্ভাবন করেছে। এখন মানবদেহে পরীক্ষা শুরুর কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ। নিপাহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিø-উএইচও) সবচেয়ে প্রাধান্যের তালিকায় থাকা একটি রোগ।


যে কারণে নিপাহ ভাইরাস নিয়ে এত ভয়
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১১ জানুয়ারি নিপাহ ভাইরাসের মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা জানিয়েছে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। সেখানে নিপাহ ভাইরাসের টিকার মানবদেহে পরীক্ষার প্রধান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব মেডিসিনের অধ্যাপক ব্রায়ান আংগেস বলেন, ‘উচ্চ মৃত্যুহার এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বৈশিষ্ট্যের জন্য নিপাহ ভাইরাসকে অতিমারি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। টিকার এ পরীক্ষাকে এ সমস্যার সমাধানে একটি মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর ফলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা যেতে পারে। বিশ্বকে ভবিষ্যতের অতিমারি থেকে রক্ষা করতে এ টিকা সহায়তা করতে পারে।’


নিপাহ ভাইরাস নিয়ে এত শঙ্কা কেন

মালয়েশিয়ায় ১৯৯৮ সালে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নিপাহ ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করে। সংস্থার দেওয়া তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত হয়। এরপর দুই দশকের বেশি সময় ধরে যতজন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৭১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। গত (২০২৩) বছর (মার্চ মাস পর্যন্ত) দেশে ১৪ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১০ জনই মারা গেছেন। ২০০১ সাল থেকে দেশে এ পর্যন্ত ৩৩৯ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৪০ জন মারা গেছেন।


নিপাহ ভাইরাস নিয়ে যে চার বিপদে বাংলাদেশ
ফলাহারী এক বাদুড় এ ভাইরাস ছড়ায়। খেজুরের কাঁচা রসে বাদুড়ের লালা বা মলমূত্র পড়ে এ ভাইরাস ছড়ায়। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা চলতি বছর খেজুরের কাঁচা রস পান না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। আইইডিসিআর বলছে, নিপাহ নিয়ে বিপদ বাড়ছে। তিনটি নতুন বিপদ দেখা দিয়েছে। এক. এবার শিশু-কিশোরেরা বেশি আক্রান্ত হয়েছে। দুই. মায়ের বুকের দুধে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তিন. নতুন করে নরসিংদীতে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
আইইডিসিআরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা সম্প্রতি বলেছেন, ‘মায়ের দুধের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস ছড়ানোর ঘটনা বিশ্বের কোথাও ঘটেনি। এটা আমাদের জন্য একটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়।’


নিপাহ ভাইরাসে উচ্চ মৃত্যুহার তো আছেই, এ ভাইরাসে একবার আক্রান্ত হলে সারা জীবন তাকে অসুস্থতা বয়ে বেড়াতে হয় বলেও জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বেঁচে থাকলেও অনেকেই মস্তিষ্কের স্থায়ী অসুখে আক্রান্ত হয়ে যায়। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায় তাদের শরীরের কোনো অংশ। কেউ কেউ স্থায়ীভাবে কাঁপুনিতে আক্রান্ত হয়।’
গবেষকেরা দেখতে চান, যাঁদের টিকা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হবে কি না।


কীভাবে হবে টিকার পরীক্ষা
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানডেমিক সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে নিপাহ ভাইরাস নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন বাংলাদেশের গবেষক মো. জাকিউল হাসান। তিনি বলেন, যে ৫১ জনের ওপর অক্সফোর্ডের টিকার পরীক্ষা হবে, তাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৫৫ বছর। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫১ জনের মধ্যে ৬ জনকে নিপাহ ভাইরাসের টিকা চ্যাডোক্স১ নিপাহবি টিকার দুই ডোজ করে দেওয়া হবে। বাকি ৪৫ জনের মধ্যে কেউ কেউ এক ডোজ টিকা এবং এক ডোজ প্লাসিবো বা ছলৌষধ পাবেন। কোনো দল দুই ডোজ টিকা পাবে বা দুই ডোজ প্লাসিবো পাবে।


ছলৌষধের কোনো নিরাময়মূলক প্রভাব না থাকলেও এটিকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত রোগীকে মানসিকভাবে আশ্বস্ত করার জন্য এ ওষুধ দেওয়া হয়। নিপাহ ভাইরাসের পরীক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা ছলৌষধ মূলত লবণাক্ত পানি।


প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাস নিয়ে আমরা কতটা সচেতন

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শিম্পাঞ্জি অ্যাডেনোভাইরাস নামক ভাইরাসের একটি দুর্বল সংস্করণ দিয়ে এ নিপাহ ভাইরাসের টিকাটি তৈরি হয়েছে। শিম্পাঞ্জি অ্যাডেনোভাইরাস প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ভাইরাস। এটি নিপাহ ভাইরাসের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কিত নয়। শিম্পাঞ্জি অ্যাডেনোভাইরাস শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে হালকা ঠান্ডা বা ফ্লুর মতো উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। জিনগত প্রকৌশল ব্যবহার করে দুর্বল শিম্পাঞ্জি অ্যাডেনোভাইরাস থেকে টিকা তৈরি করেছেন গবেষকেরা।


গবেষক জাকিউল হাসান বলেন, ‘দুর্বল এই ভাইরাস নিয়ে গবেষকেরা এর সঙ্গে নিপাহ ভাইরাসের একটি স্বতন্ত্র জিনের মিল ঘটিয়েছেন। এই জিনটি ‘‘গøাইকোপ্রোটিন জি’’ নামের নিপাহ ভাইরাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের বিষয়ে জানান দিয়েছে। গবেষকেরা দেখতে চান, যাঁদের টিকা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হবে কি না।’


অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাসের অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরিতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, নিপাহ ভাইরাসের টিকা তৈরিতেও তা করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত একাধিক দেশে এ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হবে।


জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাসের টিকার মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ একটি বড় ঘটনা। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রেও এর ট্রায়াল হয়েছে। কিন্তু অক্সফোর্ডের টিকার গুরুত্ব এখানে যে এর সঙ্গে বাংলাদেশও আছে। বাংলাদেশেও নিপাহ ভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনের কাজ চলছে। সেটাও সাফল্যের মুখ দেখবে আশা করি।’
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের তত্ত¡াবধানে মডার্না নিপাহ ভাইরাসের একটি টিকার প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু করেছিল।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *