চিকিৎসাসেবায় মানবিকতা উপেক্ষিত, বাণিজ্যই প্রধান

চিকিৎসাসেবায় মানবিকতা উপেক্ষিত, বাণিজ্যই প্রধান

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবায় নেই মানবিকতা। দখল করে নিয়েছে বাণিজ্য। এ কারণে সরকারি নানা সুবিধা থাকা সত্তে¡ও বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। অনাস্থায় হাজার হাজার রোগী যাচ্ছে দেশের বাইরে। যাদের টাকা আছে তারা দেশের বাইরে যাওয়ার পাশাপাশি রাজধানীর নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন। তবে সেখানেও আছে গলাকাটা বাণিজ্য। আর যাদের টাকা নেই, তারা মানহীন বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় অঙ্গহানী-প্রাণহানীর শিকার হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলের ৮০ ভাগ রোগীই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। ডাক্তার নেই, অজ্ঞানকারী চিকিৎসক নেই, প্যাথলজি নষ্ট-এমন নানা অজুহাত দেখিয়ে রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। কাগজ-কলমে জনবল আছে, কিন্তু বাস্তবে সরকারি হাসপাতালে জনবল নেই। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব তো আছেই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কোনো চিকিৎসা সেবা না পেয়ে শহরকেন্দ্রীক হচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থা চলে আসলেও যেমন দেখার কেউ নেই।

দেশের সব পেশাজীবী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পেশার উন্নয়নের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থোদ্ধারে বেশি নিবেদিত হয়ে পড়েছেন। যখন যে সরকার দায়িত্ব পালন করেন, তার স্বপক্ষে বেশি মানুষের ভিড় দেখা যায়। এতে সরকার আনন্দে থাকলেও শনির দশা হয় জনসাধারণের।

সরকার রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়া কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক আছে ঘরে কাছে। সেখান থেকে ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয় বিনামূল্যে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সাব সেন্টারগুলোতে মেডিক্যাল অফিসার বসেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারসহ বিভিন্ন অপারেশন, এক্সরে ও প্যাথলজির ব্যবস্থা আছে। তারপরও ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ মানুষ সরকারি চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। ডাক্তাররা বেশিরভাগ সময় থাকেন না। আর থাকলেও কমিশন বাণিজ্যের কারণে রোগীদের পাঠিয়ে দেন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে। তবে যেসব ক্লিনিকে রোগীদের পাঠানো হয় সেগুলো অবৈধ ও নিম্নমানের। চিকিৎসা সেবার ন্যূনতম ব্যবস্থা সেখানে নেই। অথচ এসব ক্লিনিকে রাজধানী ও বিভাগ থেকে নামিদামি চিকিৎসকরা যান। এ কারণে তারা রাজধানী ও বিভাগীয় পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও শনিবার পর্যন্ত থাকেন না। অনেক ক্লিনিকে এসব ডাক্তারের সেবা নিতে মাইক দিয়ে প্রচার করা হয়।

গ্রামাঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অবৈধ এসব ক্লিনিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী সমন্বিত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না রোগীরা। সিজার করতে গিয়ে মায়ের মূত্রনালী কেটে ফেলা হয়। অপারেশনের প্রয়োজন নেই, তারপরও অপারেশন করা হয়। প্রতিদিন মা ও শিশু এই ধরনের জটিলতা নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও মিটফোর্ট হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের গাইনি বিভাগে আসছেন। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় অব্যবস্থাপনায় এই সিজার করার কারণে মায়ের জটিলতার পাশাপাশি শিশুটির মাথা ও বিভিন্ন স্থানে অঙ্গহানীর ঘটনাও ঘটেছে। পরবর্তীতে এসব শিশুদের বেশিরভাগেরই বিকলাঙ্গ হয়ে জীবন পার করার আশংকা বেশি।
এদিকে গ্রামে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে শহরমুখী রোগীর স্রোত দিনদিন বাড়ছে। তবে রাজধানীতে যেসব সরকারি হাসপাতাল আছে, সেগুলো রাজধানীবাসীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতেই হিমশিম খাচ্ছে। তার উপর সারাদেশ থেকে রোগী আসতেছে। এ কারণে রাজধানীর হাসপাতালে শয্যা খালি পাওয়া যায় না। অনেকে ফ্লোরে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে।

এদিকে রাজধানীতে অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি। শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর এলাকায় শতাধিক অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর একাধিক হাসপাতালের মালিক হলেন সরকার দলীয় একজন রাজনৈতিক নেতার আতœীয়। তিনি দম্ভ করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে লিখে কিছুই হবে না। ওই হাসপাতালে লাইসেন্স নেই, কিন্তু তারপরও বড় বড় ডাক্তার সেখানে বসেন। অপরদিকে রাজধানীর নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালেও অহরহ ভুল চিকিৎসার ঘটনা ঘটছে। বাড্ডার বাসিন্দা শংকর লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। হঠাৎ তার পেটে ব্যথা হলে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা তার এনজিওগ্রাম করে বলেন, তার হার্টে ব্লক আছে। দ্রুত রিং পরাতে হবে। রিং পরিয়ে সব মিলিয়ে তার খরচ হয় পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু তার পেটের ব্যথা বন্ধ হয় না। পরে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তাররা বলেন, তার হার্টে কোনো সমস্যা নেই। সে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। এই ঘটনার পর শংকর বাংলাদেশী ওই বেসরকারি হাসপাতাল ও ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

শংকর বলেন, আমার টাকা আছে বলে বিদেশে চিকিত্সা সেবা নিতে পেরেছি। কিন্তু গরীব রোগীরা তো এতো দূরে যেতে পারবে না। রোগীদের প্রতি চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে মানবিক হওয়া উচিত। গুলশানের বাসিন্দা আরেক রোগী কোমড়ে হাড় ক্ষয়ের চিকিত্সা করাতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। সেখানে তিনি ভুল চিকিৎসার শিকার হন। পরে বিদেশে ছোট অপারেশন করে তিনি সুস্থ হয়েছেন। ওই রোগী অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, যাদের টাকা নেই, তারা এদেশে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, হাসপাতালগুলো দেখভাল করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তর পর্যন্ত আলাদা আলাদা বিভাগ আছে। কিন্তু কেউই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। তারা ধান্ধায় থাকে কোথায় থেকে কোটি কোটি টাকা বানানো যাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি বিভাগ আছে হাসপাতালগুলো দেখার জন্য। এছাড়া বিভাগীয় পর্যায়ে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন ও উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা রয়েছেন। কিন্তু কেউই সঠিকভাবে মনিটরিং করেন না। রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়ার এটি অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামান্ত লাল সেন বলেন, দেশের রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে যা যা করার প্রয়োজন তার সবই করা হবে। প্রথমে একটি বিভাগ থেকে শুরু করবো। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে স্বাস্থ্য সেবায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য সেবা জনগণের দৌরগড়ায় পর্যন্ত পৌছে দিয়েছেন। বাকিটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কর্মকর্তাদের। এটা নিশ্চিত করা গেলে শহর কেন্দ্রীক রোগীর চাপ পড়বে না। হাতের কাছে সুচিকিৎসা পাবে মানুষ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ওষুধ, পরীক্ষা, চিকিৎসাসহ সর্বক্ষেত্রে মানবিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন। পরিকল্পিত সমন্বিত মানবিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত না হওয়ায় মূলে রয়েছে বাণিজ্য। এটা বন্ধ করতে হবে। এদিকে একাধিক ডাক্তার বলেন, দেশে চিকিৎসা সেবার নামে ডাকাতি বাণিজ্য চলছে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *