আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ইবনে সিনা

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ইবনে সিনা

আমজাদ ইউনুস: ইবনে সিনার আসল নাম আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি সাধারণত ইবনে সিনা, বু-আলী সিনা এবং আবু আলী সিনা নামে পরিচিত। লাতিন ভাষায় ‘আভিসিনা’ (আরপবহহধ) নামে তিনি পরিচিত। তাঁকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। ৯৮০ সালে তুর্কিস্তানের বিখ্যাত শহর বুখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিল অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে ফেলেন। দার্শনিক আল-ফারাবি ছিলেন তাঁর গুরু। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইবনে সিনা চিকিৎসাবিদ্যায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি চিকিৎসাবিষয়ক তত্ত্বগুলো শেখার পাশাপাশি বিনা মূল্যে অসহায় রোগীদের চিকিৎসাও করতেন। দ্রুত তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি চিকিৎসায় নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে থাকেন।
১৮ বছর বয়সে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসকের মর্যাদা লাভ করেন। ইবনে সিনা চিকিৎসাবিজ্ঞান গণিত অথবা অধিবিদ্যার মতো কঠিন মনে করতেন না। তিনি অ্যানাটমিতে বিশ্বাস করতেন না এবং অস্ত্রোপচার সম্পর্কে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না। তিনি রোগ নিরাময়ে ওষুধের ওপর গুরুত্ব দিতেন বেশি।
ইবনে সিনা যৌবনে খাওয়ারিজমের তাবারিস্তানের মামুনীয় আমির শামসুল মোয়ালি আবুল হাসান ইবনে ওয়াশমাগিরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন। ৯৯৭ সালে তিনি ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। আমির কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর জন্য রাজদরবারের লাইব্রেরি উন্মুক্ত করে দেন। মাত্র অল্প কয়েক দিনে তিনি অসীম ধৈর্য ও অগাধ একাগ্রতার সঙ্গে লাইব্রেরির সব বই মুখস্থ করে ফেলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদাতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, কাব্য-সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন।
হায়ারসানিয়ায় অবস্থানকালে তিনি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত বই ‘আল-কানুন ফি আল-তিব্ব’ (ঞযব পধহড়হ ড়ভ গবফরপরহব) লিখতে শুরু করেন। ১৪ খণ্ডের ‘ক্যানন অব মেডিসিন’ তাঁকে ইতিহাসে অমর রেখেছে। অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ বইটি মুসলিম ও ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হতো।
১৬৫০-এর দশকে বইটি ফ্রান্সের মাউন্টপিলার ও বেলজিয়ামের লাউভেইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। ছোঁয়াচে ও যৌনক্রিয়াবাহিত রোগ উদ্ভাবন, সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার রোধে কোয়ারেন্টিন চালু, পরীক্ষামূলক ওষুধ ব্যবহার, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, স্নায়ু রোগের চিকিৎসা, ঝুঁকির উপাদান বিশ্লেষণ, লক্ষণ দেখে নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় এবং মাইক্রো-অর্গানিজমের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণার জন্য বইটি সুপরিচিত।
ইবনে সিনার ক্যানন অব মেডিসিনে গালেন ও হিপোক্রেটসের নীতিমালার ভিত্তিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা স্থান পেয়েছে। সিনার ‘আল-কানুন ফি আল-তিব্ব’ (ঈধহড়হ ড়ভ গবফরপরহব)-এর একটি লাতিন কপি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিআই নিক্সন মেডিক্যাল হিস্টোরিক্যাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত।
ইবনে সিনা স্নায়ু চিকিৎসার অগ্রপথিক ছিলেন। তিনিই প্রথম স্মৃতিভ্রষ্টতা, অনিদ্রা, মানসিক বিকার, দুঃস্বপ্ন, অবসাদ, চিত্তভ্রংশ, মৃগীরোগ, পক্ষাঘাত, স্ট্রোক, ঘূর্ণিরোগসহ অসংখ্য স্নায়ুবিক দুর্বলতার বর্ণনা দেন। তিনি আকুসংশ্লিষ্ট অসুস্থতার জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা প্রদান করতেন এবং অভ্যন্তরীণ অনুভূতিসহ নাড়ির স্পন্দন পরিবর্তনের একটি ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছিলেন।
ইবনে সিনা লেখালেখি ও গবেষণার কাজে কোনো জটিলতায় আটকে গেলে অজু করে মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করতেন। সিজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে বলতেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমার জ্ঞানের দরজা খুলে দাও। জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোনো কামনা নেই।’
ঘরে এসে আবার গবেষণা শুরু করতেন। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন। ঘুমে অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো স্বপ্নের মতো তাঁর মনের মধ্যে উদিত হতো এবং তার সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতেন। ঘুম থেকে জেগে উঠেই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *