অ্যান্টার্কটিকায় বরফ সর্বনিম্ন পর্যায়ে

অ্যান্টার্কটিকায় বরফ সর্বনিম্ন পর্যায়ে

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: অ্যান্টার্কটিকা ঘিরে ভাসমান বরফের পরিমাণ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবিতে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে অ্যান্টার্কটিকা। এখানকার বরফের বিস্তৃতি পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বরফ গলনের নতুন এ তথ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে বেশ উদ্বেগের বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডাটা সেন্টারের গবেষক ওয়ালটার মেইয়ার বলেন, ‘আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, তা বাহ্যিক অংশ মাত্র। ব্যাপারটি প্রায় হতবাক হওয়ার মতো।’ মেরু অঞ্চলবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, অ্যান্টার্কটিকায় বিপর্যয় ঘটলে তার পরিণতি সুদূরপ্রসারী।
অ্যান্টার্কটিকার বরফের বিস্তৃতি পৃথিবীর তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বরফের সাদা পৃষ্ঠ সূর্যের তাপ প্রতিফলিত করে বায়ুমণ্ডলে পাঠিয়ে দেয় এবং এর নিচের স্তর ও চারপাশের পানিকে ঠাণ্ডা রাখে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর রেফ্রিজারেটরের ভূমিকা থেকে রেডিয়েটরে পরিণত হবে। উল্লেখ্য, রেডিয়েটর ইঞ্জিনের তাপকে বাইরে বের করে দেয়।
বর্তমানে অ্যান্টার্কটিকায় ভাসমান বরফভূমির বিস্তৃতি এক কোটি ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটারের চেয়ে কিছু কম। সেখানে বর্তমানে যে পরিমাণ বরফভূমি থাকার চিত্র পাওয়া গেছে, তা প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরের গড় পরিমাণের চেয়ে ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার কম। অর্থাৎ শীতকালীন বরফের পরিমাণ এখন যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বনিম্ন। বলা হচ্ছে, মহাদেশটিতে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পাঁচ গুণের সমান এলাকায় এখন আর বরফ নেই। ওয়ালটার মেইয়ার বলছেন, বেশ ভালো পরিমাণে সমুদ্র-বরফ ফিরে আসবে, এমনটা তিনি মনে করেন না।
বিজ্ঞানীরা সমুদ্র-বরফ হ্রাসের সুনির্দিষ্ট কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন। তবে অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণাকর্ম চালানো সব সময়ই বেশ জটিলতাপূর্ণ কাজ।
চলতে থাকা গবেষণার মাঝপথে বিজ্ঞানীদের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে গত জুলাই মাসে গণমাধ্যমে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রের পানি ও বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি মেরু এলাকার বরফ গলনের গতি অভূতপূর্বভাবে বেশি এবং এসব ঘটনা ঘটার সময়কালও উদ্বেগজনক। তখন বিজ্ঞানীরা বরফ গলনের দিকে মনোযোগ দেওয়ার আহবান জানান।
অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে কাজ করা কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রুবি ম্যালেট বলেন, ‘চলতি বছর চরম ঠাণ্ডা ও জোরালো বাতাসের মধ্যে সমুদ্র-বরফের পাতলা স্তর গবেষণাকাজ কঠিন করে তুলেছে। ভাঙা বরফের কারণে আমাদের সমুদ্রের পানিতে ভেসে যাওয়ার মতো ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।’
গ্রীষ্মে গলনের আগে মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে শীত মৌসুমে সমুদ্র-বরফ তৈরি হয় অ্যান্টার্কটিকায়। পুরো বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত।
ক্রমহ্রাসমান বরফ গলনের প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘আইস-অ্যালবেডো ইফেক্ট’, যার মাধ্যমে সমুদ্র-বরফের স্তর সূর্যের তাপকে প্রতিফলিত করার পরিবর্তে আত্তীকরণ করে। সমুদ্রের অন্ধকার অঞ্চলকে উন্মুক্ত করে দেয়। এর ফলে তাপশক্তি বরফ গলা পানিতে যুক্ত হয়, যা অন্য দিকের বরফকে বিনষ্ট করে। এই প্রক্রিয়া বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করার ভূমিকার বদলে গ্রহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।
যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিমবাহ বিশেষজ্ঞ মার্টিন সেইগার্ট বলেন, ‘আমরা কি এই ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগিয়ে তুলছি? এটি গোটা বিশ্বের জন্য একেবারে বিপর্যয়কর হতে যাচ্ছে।’
১৯৯০ সালের পর থেকে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলন সমুদ্রের পানির উচ্চতা ৭.২ শতাংশ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
বর্তমান অবস্থা নিয়ে অধ্যাপক সেইগার্ট বলেন, ‘৩০ বছর আগে আমরা অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণাকাজে গেলে সেখানে চরম আবহাওয়ার কথা কখনো কল্পনা করতে পারতাম না।’
গত ফেব্রয়ারিতে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গত শতকের সত্তরের দশকের শেষ দিকে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে অ্যান্টার্কটিকার বরফের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহাদেশটির বরফ এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বরফ হ্রাস পাওয়া এলাকার পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের মতো। গত বছরের ২৫ ফেব্রæয়ারিতে ছিল ১৯ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটারের মতো। চলতি বছর ছাড়াও গত বছর ও ২০১৭ সালের গ্রীষ্মে রেকর্ড মাত্রায় বরফভূমি কমে যায়।
ড. ম্যালেটের মতো অনেক বিজ্ঞানী বরফ গলনের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক প্রাকৃতিক ঘটনা, সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রস্রোত ও বাতাসের গতি-প্রকৃতিকে এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘পুরো পরিস্থিতি অ্যান্টার্কটিকার জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সতর্ক সংকেত, যা গত ৪০ বছরে দেখা যায়নি।’

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *