জি-২০ সম্মেলন ও বাংলাদেশ

অনুপ সিনহা: বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর জি-২০ গ্রুপের সদস্য নয়। সদস্য দেশগুলো ছাড়াও শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক দেশ ভারত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরো ৯টি দেশকে ‘অতিথি দেশ’ হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। জি-২০ সম্মেলনে এসব দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে সব দেশের জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত থাকেন। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘অতিথি দেশ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সুযোগ থাকে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সমন্বয়ক হর্ষবর্ধন শ্রিংলার মতে, জি-২০ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নীতিকে প্রভাবিত করার একটি বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশ ও ভারতের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে এটিই হচ্ছে শেষ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। বৈঠককে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও ক‚টনৈতিক মহলের দৃষ্টি এখন দিল্লিতে।
সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তাদের ‘সোনালি অধ্যায়’ পার করছে। এই দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বের ওপর সিলমোহর দিতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের বিশেষ অতিথি হিসেবে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। এতে বাংলাদেশকে অতিথি হিসেবে ভারতের আমন্ত্রণে দেশটি তার নিকটতম প্রতিবেশীকে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হিসেবে উচ্চ অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়েছে।
ভারতের কাছে বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ-এমন প্রশ্নের বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০২১-২২ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মহামারি সত্তে¡ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০১৯ সালের ৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২১ সালে ১৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব বিশ্বের দ্রæত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ভারতের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভৌগোলিকভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর মধ্যে অবস্থিত বাংলাদেশ তার বাণিজ্য ও যোগাযোগ উন্নত করার জন্য কাজ চলছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ও ত্রিপুরাকে উপকৃত করবে। দুই দেশের বাণিজ্যের জন্য বেশ কিছু নতুন পোর্ট অব কল এবং প্রোটোকল রুটে যুক্ত করা হয়েছে। সড়কযোগাযোগ আরো উন্নত করার জন্য ২০২১ সালে ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু নির্মিত হয়েছে, যা ভারতের ত্রিপুরার সাব্রæমকে বাংলাদেশের রামগড়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। পদ্মা সেতুও দুই দেশের মধ্যে সংযোগ উন্নত করতে অবদান রাখছে। রেলসংযোগের দিক দিয়ে ২০২২ সালে উত্তর পশ্চিমবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ঢাকা পর্যন্ত মিতালি এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্বোধন হয়েছে। আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন উদ্বোধন হচ্ছে। রিজিওনাল কানেক্টিভিটি বাদ দিলে অশান্তিপূর্ণ উত্তর-পূর্ব ভারতে শান্তি এনে দিয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারতের কাছে অপরিহার্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।
২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ভারত জি-২০-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে। এক বছরের জন্য ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে এ বিষয়ে দায়িত্ব নিয়েছে ভারত। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। তিনি ঐক্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ কারণেই জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের মূলমন্ত্র ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’।
১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রæপ মূলত উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উদ্বেগ নিয়ে আলোচনার দিকে মনোনিবেশ করে। এটি আর্থিক খাত, করের ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক আর্থিক খাত সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে গঠিত। আর্থিক সংকটের আলোকে সংস্থাটি অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনের উড সিস্টেম পরিবর্তন করেছে। জি-২০ গ্রæপ বছরে একবার মিলিত হয় এবং এজেন্ডাটি প্রায়শই প্রবৃদ্ধির কৌশল, আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতার ওপর নজর রাখা এবং অননুমোদিত আর্থিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করে।
এবার জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের দায়িত্বে রয়েছে ভারত। উদীয়মান দেশগুলোর গ্লোবাল সাউথের মুখোমুখি অগণিত চ্যালেঞ্জের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করাই ভারতের লক্ষ্য। ইউক্রেনের সংঘাত নিয়ে রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে মতবিরোধের ফলে ভারত এখন একটি কঠিন ক‚টনৈতিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ‘অতিথি দেশ’ হিসেবে মনোনীত হওয়া বাংলাদেশের জন্য সম্মানের বিষয়। আমন্ত্রণে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রতিনিধিরা ঢাকার প্রতিনিধিদের পাশাপাশি জি-২০ ফোরামের বিভিন্ন বৈঠকে যোগ দেন। বর্তমানে কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন। ভবিষ্যতে মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এসব বৈঠকে উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ বেশ কিছু সুপারিশ পেশ করবে। পুরো বছর বিভিন্ন প্রোগ্রাম থাকবে।
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনেও একই ধরনের বিবৃতি দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যেমনটি জাতিসংঘে বাংলাদেশ দিয়েছে। রোহিঙ্গা-সংকট, অবকাঠামো উন্নয়ন, মহামারি মোকাবিলা এবং বাংলাদেশের জন্য অন্যান্য শীর্ষ উদ্বেগ বিশেষভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে ২০০ থেকে ২৫০টি সভা হবে। প্রতিটি বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
জি-২০-এর সভাপতি হিসেবে অন্যান্য উদীয়মান দেশের নেতৃত্ব গ্রহণের সুযোগ ভারতের জন্য কেবল একটির চেয়ে বেশি। বিশেষ করে ভারতের সীমান্তবর্তী দেশগুলোর জন্য সুযোগ রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশগত জীবিকা এবং খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তাসহ আজকের প্রধান উদ্বেগের বিষয়ে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের এখন একধরনের সুযোগ রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১৯টি দেশ জি-২০ নিয়ে গঠিত। আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সদস্য। একটি আঞ্চলিক সংস্থা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশ, মিশর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন ও সংয়ুক্ত আরব আমিরাত-এই ৯টি অতিথি দেশ।
আন্তর্জাতিক জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একান্তে বৈঠক করবেন তার বাসভবনে। এর প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দুই দেশের পৃথক আলোচনা কীভাবে অগ্রসর হয়েছে, তা নিয়ে কথা বলাই উপযুক্ত। এ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দুই নেতার ব্যক্তিগত আলোচনা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে শেখ হাসিনার সা¤প্রতিক তিনটি দেশ সফর। আসন্ন নির্বাচনের পাশাপাশি জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রাজনৈতিক অঙ্গনে, টেলিভিশনে এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় ছিল আলোচিত বিষয়।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক ক‚টনৈতিক সম্পর্ক বিভাজনমূলক হয়ে উঠেছে। আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এসব সমস্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। উদীয়মান মেরুকরণে বাংলাদেশ হয়তো রাশিয়া-চীন জোটকে আরো বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
এই সংস্থার সভাপতি ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সভা এবং শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। বাংলাদেশ, মিশর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারত থেকে সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। এই আমন্ত্রণ পাওয়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য সম্মানের।
এই উভয় সাক্ষাৎ দেশের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। গত ১০ মে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘পশ্চিমা চাপে ভারতের পাশে থাকতে চায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সত্যিকার অর্থে কী চায়।’ তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ব্রিটেন সা¤প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশের সা¤প্রতিক নির্বাচনের বিষয়ে নানা কথা হচ্ছে। বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতকে এই পরিস্থিতি নিয়ে ক‚টনৈতিক আলোচনায় সম্পৃক্ত করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। ঢাকা মনে করে, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নেতৃত্বের দায়িত্বে রয়েছে, তাই পশ্চিমাদের নয়াদিল্লি যা বলে, তার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
কিন্তু শেখ হাসিনা কি শুধু ভারতের কাছে ক‚টনৈতিক সহায়তা চাইবেন? না। তিস্তার পানি বণ্টন একটি আলোচিত ইস্যু। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষপাতদুষ্ট বিরোধিতার কারণে তিস্তা ইস্যু আলোর মুখ দেখেনি। নয়াদিল্লিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টিও উত্থাপিত হয়েছে বলে জানা গেছে। রবিবার (৩ সেপ্টেম্বর) পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের তিস্তার পানি বণ্টনের ইস্যু আছে, যা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী উত্থাপন করবেন। আমাদের আরো কিছু সমস্যা আছে।’
যাই হোক, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন হবে সরকারের জন্য একটা সুযোগ। কারণ এটি পশ্চিমে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক নিরসনে একটি বড় ফ্যাক্টর হবে বলে অনেকে মনে করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা এই বৈঠকে যোগ দিয়েছেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *