৭০০০ কোটি টাকায় স্মার্ট কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প

৭০০০ কোটি টাকায় স্মার্ট কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প

বাণিজ্য ডেস্ক: ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। দেশে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা গড়তে অনেক দেশ ইতোমধ্যে উদ্বৃত্ত খাদ্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে আমদানি করে খাদ্যের জোগান দেওয়া দেশগুলো বড় ধরনের বিপাকে পড়তে যাচ্ছে। উল্লিখিত পরিস্থিতিতে সরকার আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ৭ হাজার ২১৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে গত জুলাই মাস থেকে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে।
সরকার, বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (ইফাদ) যৌথভাবে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে প্রোগ্রাম অন অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার ব্যয় করবে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বাকি অর্থ ব্যয় করবে উন্নয়ন সহযোগীরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের অওতায় পাঁচ বছরে প্রায় দুই কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৩২১ কৃষক পরিবারকে দেওয়া হবে স্মার্টকার্ড। কার্ডধারী কৃষকরা পাবেন প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা এবং ঋণ সহায়তা। ই-ভাউচারে দেওয়া হবে ভর্তুকি। ভ্রাম্যমাণ প্ল্যান্ট ক্লিনিকে দেওয়া হবে কৃষি সম্প্রসারণ সেবা। ড্রিপ, স্প্রিংলার, এব্লিউডি ও ভূগর্ভস্থ সেচ নালে পানি সরবরাহ করা হবে। সেচকাজে ব্যবহার করা হবে সৌরশক্তি। স্মার্টকার্ডধারী সব কৃষককে দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ। ৪টি আঞ্চলিক কৃষি কার্যালয় ও প্রশিক্ষণ ভবন ও ১০টি জেলা কৃষি কার্যালয় কাম প্রশিক্ষণ ভবন তৈরি করে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। জানতে চাইলে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, বড় ধরনের প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে দেশে খাদ্যের কোনো সংকট হবে না। যেসব পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি তা বাস্তবায়ন হলে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হবে। উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হবে। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট কৃষি সম্প্রসারণে কাজ করছে। পার্টনার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা চেষ্টা করতে পারি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনেক সময় ঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শের অভাবে ফসল বিনষ্ট হয়। সেক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কৃষি বিষয়ে কারিগরি পরামর্শ প্রদানের জন্য ২৫৩টি যানবাহনে মোবাইল ক্রপ ক্লিনিক স্থাপন করে সেবা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে সেচকাজ চালানো হচ্ছে। ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ। এখন থেকে সৌরশক্তি ব্যবহার করে ১৫০টি ড্রিপ ও ১৫০টি স্প্রিংলার সেচ কাঠামো স্থাপন করা হবে।
বর্তমানে দেশে মোট চাষযোগ্য জমি ৮৮ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এ সময়ের মধ্যে তিন লাখ হেক্টর জমিতে গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্রাকটিস সার্টিফাইড ফল ও সবজি আবাদ করা হবে। দুই লাখ হেক্টর জমিতে জলবায়ু পরিবর্তন সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ধান আবাদ করা হবে। দুই লাখ হেক্টর জমিতে ধান ছাড়া দানাদার ডাল ও তেলবীজ, ফল ও সবজি জাতীয় ফসল আবাদ করা হবে। তার মধ্যে দানাদার ডাল ও তেলবীজ জাতীয় ফসল উৎপাদনের এ উদ্যোগ নতুন করে নেওয়া হলো। এছাড়া বর্তমানে দেশে যেসব এলাকায় সেচের মাধ্যমে আবাদ করা হয় তার বাইরে আরও এক লাখ হেক্টর জমি উন্নত মানের সেচের আওতায় আনা হবে। স্থাপন করা হবে সিড টেস্টিং ল্যাবরেটরি। গত জুলাই থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে প্রধান এজেন্সি হিসাবে নিয়োগ দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন আরও ছয়টি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধানের উৎপাদন হচ্ছে। দিন দিন ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সব ধরনের আলুর রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে। গত বছর ১ কোটি ৩৪ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আলু বিদেশে রপ্তানিও করা হয়। দেশে ভুট্টার উৎপাদন ৭০ থেকে ৭৫ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদা ৬৫ থেকে ৬৮ লাখ মেট্রিক টন। ভুট্টা উদ্বৃত্ত থাকছে প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন। সরিষা চাহিদার ৪০ শতাংশ দেশে উৎপাদন হচ্ছে। বার্ষিক ২৪ লাখ মেট্রিক টন ভোজ্যতেল দরকার। সেক্ষেত্রে সরকার ডাল ও তৈলজাতীয় ফসল উৎপাদনে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে।
তারা আরও জানান, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর দেশে ৩৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। আগামী দিনে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্ষাসহনশীল এক ধরনের পেঁয়াজের বীজ আবিষ্কার করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। তাছাড়া অমৌসুমে সংরক্ষণের জন্য এক ধরনের সংরক্ষণাগারও আবিষ্কার করা হয়েছে। সুতরাং আগামী দিনে পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন হবে না। সবজির উৎপাদন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, আগের চেয়ে প্রায় ৭ গুণ বেশি সবজি উৎপাদন হচ্ছে। সব ধরনের ফল এখন আগের চেয়ে শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে আনারস, পেয়ারা, কলা, পেঁপে বছরজুড়ে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। আমও বছরে প্রায় ৫ মাস বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। নিকট-ভবিষ্যতে আম ১২ মাসেই বাজারে পাওয়া যাবে। দেশে গম উৎপাদন হয় না। গম উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ শীত থাকা দরকার তা আমাদের দেশে পড়ে না। সুতরাং কৃষির সব সেক্টরে উন্নয়ন ও উন্নতি হলেও গম কখনোই দেশে উৎপাদন সম্ভব হবে না। দেশের গমের বার্ষিক চাহিদা ৬৫ থেকে ৭০ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ১২ থেকে ১৫ লাখ মেট্রিক টন। বাকিটা আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়।
তারা আরও জানান, সব ধরনের মাছ এখন দেশে উৎপাদন হচ্ছে। আমিষের বিরাট একটি উৎস হচ্ছে মাছ। পুষ্টিসমৃদ্ধ সব ধরনের মাছ দেশে ব্যাপক হরে চাষাবাদ হচ্ছে। তাছাড়া দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় এবং সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ মাছ ব্যাপক হারে উৎপাদন হচ্ছে। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে এখন প্রথম সারিতে বাংলাদেশ। এছাড়া হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগলের ব্যাপক প্রতিপালন হচ্ছে। দেশে বিপুলসংখ্যক গরু ও ছাগলের খামার গড়ে উঠেছে। ডিম ও মাংস পুষ্টির চাহিদা মেটাচ্ছে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *