এলডিসি থেকে উত্তরণ ও রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জ

এলডিসি থেকে উত্তরণ ও রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জ

এমরান কবির: বেশিদিন আগের কথা নয়, গত শতাব্দীতেই ‘লাখের বাতি’ জ্বালানোর প্রচলন ছিল আমাদের বঙ্গদেশে, বিশেষত ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলে। লাখের বাতি হলো কোনো ব্যক্তির স্বেচ্ছায় লাখ টাকার মালিক হওয়ার ঘোষণা দেওয়া। সেই ঘোষণা শুধু মুখে চোঙা লাগিয়ে চিল্লানি দিলেই হবে না, দিতে হবে আয়োজন করে। বাঁশের মাথায় বাতি জ্বালাতে হবে। যে অঞ্চলে তিনি বসবাস করেন, সেখানকার সবাইকে এক বেলা খাওয়াতে হবে। এই ঘোষণার সঙ্গে রয়েছে অনেক কিছুর সম্পর্ক। যেমন-সমাজে তিনি বিশেষ সম্মানের অধিকারী হবেন, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁর মতামত ছাড়া গ্রহণ ও কার্যকর করা হবে না, বিয়েশাদি এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অবশ্যই নিমন্ত্রিত হবেন। আর সমস্যা হলো, তিনি ঋণ করতে পারবেন না।
করলে তা অত্যন্ত অসম্মানজনক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকহ হুমায়ূন আহমেদের বিশালায়তনিক উপন্যাস ‘মধ্যাহ্ন’-তে এ বিষয়ে চমৎকার উপস্থাপনা রয়েছে।
ব্যক্তির লাখের বাতি জ্বালানোর প্রচলন কবে যে উঠে গেল, তা আর কেউ মনে করতে পারে না। এখন দেশে হাজারো লোকের কাছে লাখ টাকা নিছক ‘হাতের ময়লা’।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অবশ্য একটু-আধটু চোখ রাঙানি দেয় মাঝে মাঝে কর আদায়ের জন্য। কিন্তু দেশে দেশে ব্যক্তির মাথাপিছু আয় কত, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে দেশের অর্থনীতির অনেক উপাদানের সূচক। পৃথিবীতে চার শ্রেণির দেশ আছে। নিম্ন আয়ের দেশ, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ, উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ ও উচ্চ আয়ের দেশ।
আমরা লাখের বাতি জ্বালানোর মতো এরই মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছি। আরো কিছু অর্থনীতির উপাদানের সূচকের মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে ২০২৬ সালে আমরা অফিশিয়ালি এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে যাব। প্রবেশ করব উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।
সব ঘটনার একাধিক দিক থাকে। সুবিধা-অসুবিধা থাকে। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে আমরা কিছু সুবিধা-অসুবিধার মধ্যে পড়ব। সেগুলোর মধ্যে একটি অসুবিধা হলো, রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) থাকবে না। ২০২৬ সালের শেষে এই সুবিধা প্রথমে সংকুচিত হতে থাকবে আর ২০২৯ সাল থেকে একেবারে উঠে যাবে। এর ফলাফল কী হবে তার একটি চিত্র উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) একটি প্রতিবেদনে। তা হলো এলডিসি তালিকা থেকে বের হওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ২০২৭ সালে ব্যাপক রপ্তানি ক্ষতির মুখে পড়বে, যার পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি ডলার। বর্তমান বাজারদরে এই ক্ষতি দেশীয় মুদ্রায় দাঁড়াবে ৭৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ধরে)।
এখন বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ পণ্য কোনো না কোনোভাবে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধার আওতায় রপ্তানি হয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এই সুবিধা থাকবে না। রপ্তানি খাতই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এ খাতের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত। প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে। ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ওই বাজারে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জন্য এরই মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমার আশঙ্কা রয়েছে। উল্লেখ্য, তৈরি পোশাক খাত থেকেই বর্তমানে ৮২ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে।
যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগে পটভূমি ও করণীয় জানা দরকার। এই কাজ করতে হবে যথাসম্ভব দ্রুত আর পদক্ষেপ হতে হবে কার্যকর, তত্ত্বীয় বা বায়বীয় নয়। হতে হবে ব্যাবহারিক (প্র্যাকটিক্যাল)। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) এই বিষয়ে কাজ করছে। বিভাগটি আশা করছে, ২০২৪ সালের মধ্যেই সব কাজ শেষ করতে পারবে।
এই রপ্তানি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন-যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের বাজার সুবিধা না থাকলেও সেখানে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি রয়েছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমাদের বাজার ধরে রাখতে হবে এবং প্রবৃদ্ধি অক্ষুণœ রাখতে হবে। দাম ও মুনাফা কমিয়ে বাজার ধরে রাখতে হবে। নজর দিতে হবে এফটিএ (ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট-বিনা শুল্কে পণ্য আমদানি-রপ্তানির চুক্তি), পিটিএ (প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট-অগ্রাধিকারমূলক পণ্যের আমদানি-রপ্তানি চুক্তি), অর্থনৈতিক অংশীদারি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং পণ্যের গুণগত মান বাড়ানো। করতে হবে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, শুল্ক ও কর যৌক্তিককরণ।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *