১০ টাকায় চিকিৎসা দেন তিনি

১০ টাকায় চিকিৎসা দেন তিনি

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: একাত্তরে তিনি সদ্য কৈশোর পার হওয়া টগবগে তরুণ। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধাহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। যুদ্ধে কেউ আহত হয়েছেন শুনলেই ছুটে যান। সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। তরুণ বয়সের সেই চেষ্টা, সেবার সেই মানসিকতা আজও ধারণ ও লালন করে চলেছেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এমবিবিএস পাস করেন। চিকিৎসাপেশায় যুক্ত হন। চাকরি করেন কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে। সিভিল সার্জনও হন। চাকরির বাইরে চেম্বারে বসে রোগী দেখেন। ফি নেন মোটে ১০ টাকা। ৪৩ বছর ধরে ওই কয় টাকায় রোগী দেখছেন তিনি। রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষ তাঁর রোগী। মানুষের কাছে তিনি ‘গরিবের ডাক্তার’, কারও কাছে ‘১০ টাকার ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত। নাম তাঁর এবায়দুল্লাহ। বাড়ি সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুর এলাকায়।

ভদ্র ও বিনয়ী হিসেবেও তাঁর সুনাম আছে। চাকরি কিংবা ব্যক্তিজীবনে কারও সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলেননি। কারও সঙ্গে বিরোধে জড়াননি। বিত্তবৈভব নয়, মানসিক তৃপ্তিটাই তাঁর কাছে বড়। খুব বেশি কিছু চাওয়া নেই তাঁর। বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে শহরের পাকাপোল মোড়ে নবাব ক্লিনিকে তাঁর চেম্বার। রোজ দুবেলা হেঁটে যাওয়া-আসা করেন সেখানে। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী দেখেন।

এবায়দুল্লাহ সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক কলেজ অধ্যক্ষ সুভাষ সরকার বলেন, অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী ডাক্তার এবায়দুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে একরকম বিনা পয়সায় সাতক্ষীরার মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘জনতার ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত। এই যুগে তাঁর মতো মানুষ বিরল। তাঁকে কখনো টাকার পেছনে ছুটতে দেখা যায়নি।

দাদার অনুপ্রেরণা
ছোটকাল থেকে নানা সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবায়দুল্লাহ। তাঁর দাদা নবাব আলী সরদারও সামাজিক কাজ করতেন। এলাকার মানুষ, আত্মীয়স্বজন বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়াতেন। দাদার খুব ইচ্ছা ছিল, তিনি (এবায়দুল্লাহ) চিকিৎসক হয়ে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। দাদার ইচ্ছাতেই তিনি মেডিকেলে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে সাতক্ষীরা শহরের পাকাপোলের মোড়ে চেম্বার নেন। একসময় উপলব্ধি করেন, চিকিৎসকের ফি দিতে গিয়ে অনেক রোগী প্রয়োজনীয় ওষুধই কিনতে পারেন না। তিনি নিজের ফি ৫ টাকা নির্ধারণ করেন। দাদার নাম অনুসারে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম দেন নবাব ক্লিনিক। সেই ’৮০ সাল থেকে নিয়ম করে রোজ বেলা সাড়ে তিনটা থেকে চেম্বারে বসে রোগী দেখেন। ২০১০ সালে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর সকাল-বিকেল দুই বেলা রোগী দেখা শুরু করেন। ৫ টাকার ফি বাড়িয়ে নেন ১০ টাকা।

ফি বাড়ানোর কারণ হিসেবে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে সেবিকা ও তাঁর সহকারী হিসেবে আটজন কর্মচারী রয়েছেন। শহরের কেন্দ্রস্থলে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। এ ছাড়া অনেক দিন ধরে ৫ টাকার চলও উঠে গেছে। ৫ টাকা লেনদেনেও ঝামেলা বেশ। এসব বিবেচনায় তিনি ফি বাড়িয়েছিলেন।

ফি না দিলেও রোগী দেখেন এবায়দুল্লাহ। কিন্তু কর্মচারীদের বেতন, খরচাপাতি দেন কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাতে গোনা কয়েকটা রোগনির্ণয়ের যন্ত্রপাতি আছে তাঁর এখানে। ইসিজির ব্যবস্থাও আছে। রোগীরা চাইলে নামমাত্র মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারেন। এখান থেকে আসা টাকার পুরোটাই তিনি কর্মীদের পেছনে ব্যয় করেন। নিজে কিছু নেন না।

ভবিষ্যতে আর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে চিকিৎসক এবায়দুল্লাহ বলেন, নতুন কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে যে কদিন বেঁচে আছেন, সুস্থ থাকতে চান। সুস্থ থেকে গরিব-মেহনতি মানুষের চিকিৎসা দিতে চান।Ñএটাই তাঁর একমাত্র ইচ্ছা।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *