শুরু হলো প্রাণের মেলা

শুরু হলো প্রাণের মেলা

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছু নিয়ে এগিয়ে যেতে হলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত। আমি প্রকাশকদের অনুরোধ করব, প্রকাশকরা শুধু কাগজের প্রকাশক হলে হবে না, ডিজিটাল প্রকাশক হতে হবে। ডিজিটাল হলে শুধু আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও সবার কাছে এটা পৌঁছাতে পারব। অন্য ভাষাভাষী লোকেরাও পড়বে।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৪-এর উদ্বোধনের আগে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এরপর তিনি বইমেলার উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, লাইব্রেরিগুলোতেও সঙ্গে সঙ্গে অডিও ভার্সন থাকবে, অডিও ভার্সনের কিন্তু প্রয়োজন আছে। সেটাও থাকলে অনেকের সুবিধা। শুনবে, জানতে পারবে, সে ব্যবস্থাটাও আমাদের নেওয়া উচিত। এটাই সব থেকে দরকার। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললে আমরা এগিয়ে যাব। তিনি বলেন, আমি একটা কথা বলব যে, এখন আমাদের যুগটা হয়ে গেছে বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগ। বই প্রকাশ এটা অবশ্যই থাকবে, এটা যাবে না। কারণ, একটা বই হাতে নিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে আলাদা একটা আনন্দ আছে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা আবার ট্যাবে করে বই পড়ে অথবা ল্যাপটপে পড়ে। যদিও আমরা ওইভাবে খুব একটা আনন্দ পাই না।
শেখ হাসিনা বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাস। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সত্তা জাগ্রত হয় এবং এই পথ বেয়েই পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। তিনি বলেন, অনেকের ঘুম না এলে ঘুমের ওষুধ খান। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার দরকারটা কী। একটু বইটই পড়লে, বই একটু হাতে নিলে ঘুম চলে আসবে। আমি সেটা নিজেই মনে করি। তিনি বলেন, পড়ার অভ্যাসটা সবার থাকা উচিত। বাবা-মা যদি ছোটবেলা থেকে শেখাই তাহলে কিন্তু পড়ার অভ্যাসটা হবে। কঠিন একটা প্রবন্ধ পড়লেই ঘুমটা তাড়াতাড়ি আসবে। বেশি মজারটা পড়লে কিন্তু আবার ঘুম চলে যাবে। এ জন্য বেছে নিতে হবে এমন একটা বই, যেটা পড়লে তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসবে। তাহলে দেখবেন আরামেই ঘুমাবেন। আমি প্রায়ই এটা অনুসরণ করি। সরকার প্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বাংলা ভাষা মধুর। এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। এরপরও বই প্রকাশ হবে। তা কখনো যাবে না। বই পড়ার আনন্দ আছে। তিনি বলেন, ভাষার সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত। তাই প্রকাশকদের বলব, এখন থেকে বই ডিজিটালি প্রকাশ করতে হবে। এতে শুধু দেশ নয়, বিদেশেও আমাদের ভাষার বই পৌঁছাতে পারব। অন্য ভাষাভাষীর লোকজনও আমাদের বই পড়ে। ইতিহাস টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মোনায়েম খান রবীন্দ্রসংগীত বন্ধ করতে বলেছিলেন। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক হাই। মোনায়েম খান বলেছিলেন, এখানকার শিক্ষকরা কেন রবীন্দ্রসংগীত রচনা করতে পারেন না? তখন উত্তরে হাই বলেছিলে, উনি লিখতে পারেন, তবে সেটি রবীন্দ্রসংগীত না, হবে হাই সংগীত! তাহলে বোঝেন, কেমন রাষ্ট্রের অধীনে ছিলাম আমরা! তিনি আরও বলেন, সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে অনেক ইতিহাস জানা যায়। আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা। এর প্রতিবাদ এ দেশের মানুষ করেছে। যখন থেকে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা মর্যাদা অর্জনের জন্য আন্দোলন শুরু হয়, তখন থেকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধুর পেছনে লেগে থাকে। তার ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে সংস্থাটি। অমর একুশের বইমেলা সাধারণ মানুষের কাতারে থেকে ঘুরে দেখতে না পারার আক্ষেপ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীনতাই তো নাই, জানি না কবে আবার স্বাধীনতা পাব।’ বইমেলায় আসা আনন্দের জানিয়ে তিনি বলেন, আজকের এই বইমেলায় আসতে পেরে আমি আনন্দিত। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসা, এটাতে তেমন কোনো মজা নেই। কারণ স্বাধীনতাই তো নাই। ডানে তাকাব নিরাপত্তা, বামে তাকাব নিরাপত্তা, পেছনে নিরাপত্তা, সামনে নিরাপত্তা- এই নিরাপত্তার বেড়াজালে স্বাধীনতাটাই হারিয়ে গেছে। আগে স্কুলে থাকতে এখানে এসেছি, কলেজে এসেছি, ১৯৮১ সালেও এখানে আমি এসেছি- ঘুরে দেখেছি। কিন্তু এখন পারি না। এখন শুধুই নিরাপত্তা। জানি না কবে আবার স্বাধীনতা পাব। তিনি বলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন আমরা সে দেশটাই গড়তে চাই। আমরা অনেকদূর এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু করোনা, আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের ওপর আক্রমণ- এসব কারণে অর্থনৈতিক মন্দা; এসব সংকট থেকে বাংলাদেশও দূরে নয়। তারপরও আমরা আমাদের দেশটাকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব। এই দেশ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ।
এ সময় বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জড়িয়ে থাকার ইতিহাসের স্মৃতিচারণা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বলেন, আমি যতবার জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছি, আমার বাবার কথা স্মরণ করে ততবারই বাংলা ভাষায় দিয়েছি। সম্ভবত ১৯-২০ বার জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছি। খালেদা জিয়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রক্ত দিয়ে আমরা যেদিন ভাষার অধিকার আদায় করেছি সেই দিনটি এখন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি যখন আমরা পেলাম, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই এখানে একটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলব। ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করি। আমার সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ছিলেন। কাজ শুরু করি, কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারিনি। তখন খালেদা জিয়া সেই কাজটি বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, আমি ধন্যবাদ জানাই তাকে (খালেদা জিয়া), বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ভালো হয়েছিল। কারণ, দ্বিতীয়বার যখন আমি সরকারে আসি, সেটা প্রতিষ্ঠা করি। এখন সেখানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এটা যেন আরও সমৃদ্ধ হয়, সেটা আমি চাই।
বক্তব্য শেষে বইমেলা প্রাঙ্গণে অবস্থিত স্টলগুলো ঘুরে দেখেন তিনি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস অব শেখ মুজিবুর রহমান : ভলিউম-২’, প্রাণের মেলায় শেখ হাসিনা ও কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের অনুবাদ গ্রন্থ ‘ক্লাস্টার ক্লাউডস’সহ ১০টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১১টি ক্যাটাগরিতে ১৬ জনকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। এবারের মেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। সবমিলিয়ে বরাবরের মতো এবারও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকছে মেলার আয়োজন। এবারের মেলায় ৬৩৫ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পেয়েছে ৯৩৭টি ইউনিট। এবার প্রকাশনা সংস্থা বেড়েছে ৩৪টি। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০ প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি ইউনিট এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭৬৪ ইউনিট বরাদ্দ পেয়েছে ৫১৫ প্রতিষ্ঠান। প্রতি কর্মদিবসে বইমেলা বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এবং সরকারি ছুটির দিনে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং দুপুরের খাবার ও নামাজের জন্য এক ঘণ্টা বিরতি থাকবে। বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *