শিক্ষাবিস্তারে রানি দাইফা খাতুনের অবদান

শিক্ষাবিস্তারে রানি দাইফা খাতুনের অবদান

মুফতি আতাউর রহমান: দাইফা খাতুন (রহ.) ছিলেন জ্ঞানানুরাগী আইয়ুবীয় রাজকন্যা। যিনি তাঁর অর্থবিত্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তিকে জ্ঞানের সেবায় ব্যয় করেছিলেন। দাইফা খাতুন (রহ.) মিসরের আইয়ুবীয় শাসক সুলতান আল আদিলের কন্যা এবং আলেপ্পোর আমির জাহের আল গাজির স্ত্রী। তাঁর ছেলে মালিক আল আজিজও পরবর্তী আলেপ্পোর শাসক হন।
ছেলের মৃত্যুর পর নাতি মালিক আন নাসির পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তখন নাবালক নাতির পক্ষে দাইফা খাতুন (রহ.) আলেপ্পো শাসন করেন। আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) ছিলেন তাঁর আপন চাচা ও শ্বশুর।
রানি দাইফা খাতুন (রহ.) ১১৮৫ খ্রিস্টাব্দে আলেপ্পো দুর্গে জন্মগ্রহণ করেন এবং এখানেই জীবন অতিবাহিত করেন।
জন্মের পর বিপুলসংখ্যক অতিথি তাঁকে দেখতে আসেন বলে তাঁর নাম দাইফা (অতিথি) রাখা হয়। আর খাতুন দ্বারা তৎকালে অভিজাত নারীদের বোঝানো হতো। তিনি ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে বিশেষ রীতিনীতি ও আদব-শিষ্টাচারের দীক্ষা লাভ করেন। (তারিখে ইবনুল আদিম)
১২১৩ খ্রিস্টাব্দে আপন চাচাতো ভাই মালিক জাহের আল গাজির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
তাঁর বিয়ের মোহর ছিল ৫০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। তিনি যখন আলেপ্পো শহরে প্রবেশ করেন আমিরের পক্ষ থেকে অভূতপূর্ব রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিয়ের মাত্র তিন বছর পর ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে দাইফা খাতুন (রহ.)-এর স্বামী মারা যান। মালিক জাহেরের বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৪ বছর। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হন।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। ফলে নাবালক নাতির পক্ষে তাঁকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫২ বছর। ঐতিহাসিকরা তাঁর সম্পর্কে বলেন, নারী হলেও তাঁর ভেতর পাহাড়সম দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্বের প্রভাব, বীরত্ব ও সাহসিকতা ও অগাধ দেশপ্রেম বিদ্যমান ছিল। আর মুসলমান হিসেবে তিনি ছিলেন ইমানি শক্তি, আল্লাহভীতি ও নির্মোহ জীবনের অধিকারী। সৃজনশীলতা, প্রকৌশলবিদ্যা, নকশা প্রণয়ন ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ছিল তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির স্থান।
ন্যায়পরায়ণতা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন, জ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা দাইফা খাতুন (রহ.)-এর (ছায়া) শাসনকালের বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাছে বিচার চেয়ে সুবিচার পাননি এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে তিনি একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভবন, পানির কূপ ও রাস্তা নির্মাণ করেন। যার কিছু কিছু নিদর্শন এখনো টিকে আছে।
রানি দাইফা খাতুন (রহ.)-এর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি জ্ঞানের সেবক। তিনি আলেপ্পোর সর্বপ্রাচীন ধমীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘মাদরাসাতুল ফিরদাউস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটিতে এখনো পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এই মাদরাসায় তিনি সময়ের শ্রেষ্ঠ ফকিহ (ইসলামী আইনবিদ), মুহাদ্দিস ও কোরআন গবেষকদের একত্র করেন। মাদরাসাকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদ ওয়াকফ করে যান। এ ছাড়া তিনি দরিদ্র, অসহায় ও নিঃস্ব লোকদের মুক্ত হস্তে দান করতেন। জনকল্যাণ ও দানশীলতার কারণে তাকে ‘আল মালিকাতুর রহিমিয়্যা ইসমাতুদ্দুনয়া ওয়াদ-দিন’ (দয়ালু রানি, যিনি দ্বিন ও দুনিয়ার নিরাপত্তাস্বরূপ) উপাধি দেওয়া হয়।
ঐতিহাসিক ইবনে ওয়াসিল লেখেন, অসহায় বয়স্কা, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের জন্য তিনি ‘রিবাত আন নাসির’ বা খানকায়ে ফারাফিরা প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে এসব নারী নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারত। পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল। রিবাতে অবস্থানকারী নারীরা জীবনের হতাশা কাটিয়ে নিজ নিজ মেধা ও প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সমাজে পুনরায় জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ পেত।
অন্যায়ের প্রতিবাদ, আগ্রাসন প্রতিহত করা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জীবন বাজি রাখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন চাচা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-এর প্রতিচ্ছবি। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনকালে মোঙ্গলীয়, সেলজুক, খাওয়ারিজম ও ক্রুসেডার বাহিনীকে সফলভাবে মোকাবেলা করেন।
দাইফা খাতুন (রহ.) ৬৪০ হিজরি মোতাবেক ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে ৫৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *