মানুষের হাতে টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে, ব্যাংকে কমছে উদ্বৃত্ত তারল্য

মানুষের হাতে টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে, ব্যাংকে কমছে উদ্বৃত্ত তারল্য

মানুষের হাতে টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: মানুষের হাতে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। ব্যাংকে টাকা রাখার তুলনায় নিজেদের কাছেই নগদ টাকা ধরে রাখছেন অনেকেই। এর ফলে ব্যাংকিং খাতের বাইরে মুদ্রার প্রবাহ বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে মানুষের কাছে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রয়েছে, যা সা¤প্রতিক সময়ে রেকর্ড। এক বছরে নগদ টাকা হাতে রাখার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। সব মিলে ব্যাংকগুলোর কাছে উদ্বৃত্ত তারল্য কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে, যা চলতি বছরের (২০২২) সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যা ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যবধানে শতকরা হিসাবে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ এখন আগের চেয়ে মানুষ ব্যাংক থেকে বেশি নগদ টাকা উত্তোলন করছেন। বর্তমানে (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) দেশের মুদ্রাবাজারে প্রচলিত মুদ্রা আছে ১৪ লাখ ৮২ হাজার ১৭৭ কোটি টাকার। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে মেয়াদি আমানত হিসেবে রয়েছে ১৩ লাখ ৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। তলবি আমানত রয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে দেশের নগদ টাকা ও ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ যত কম, সেই দেশের অর্থনীতির গতি তত বাড়ে, ভিত শক্ত থাকে। কারণ, ব্যাংকের বাইরে টাকা থাকলে তা অর্থনীতিতে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে যখন ঘুষ-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে পথ সুগম হয় তখন ব্যাংকের অর্থ মানুষের কাছে চলে যায়। মানি লন্ডারিং আইনের ফলে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে হলে তার উৎস জানাতে হয়। কেউ অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা রাখলে তা ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বড় অঙ্কের অবৈধ অর্থ দুষ্কৃতকারীদের কাছে থেকে যায়। এই অবৈধ অর্থ দিয়ে ডলার, ইউরো বা স্বর্ণ কিনে বাসা বা নিরাপদ জায়গায় রেখে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবৈধ উপার্জনের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ব্যাংক খাতের বাইরে টাকা চলে যাওয়ার কারণ হলো করোনাকালীন মানুষের হাতে নগদ টাকা রাখার একটা প্রবণতা বেড়েছে। সেটা এখনো চলছে। এর পরে ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে। ব্যাংক খাতের ওপর সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক প্রচারণায় নগদ টাকা হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। এসব আস্তে আস্তে কমে আসবে যদি ব্যাংকের আস্থাহীনতা কমে আসে। এর বিপজ্জনক দিক হলো সবাই যদি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে শুরু করে তাহলে ব্যাংকিং সেক্টর বিপদে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, গত এক দশকে দেশে ব্যাংক খাতের বিপুল সমপ্রসারণ হয়েছে। ব্যাংকিং সেবা অনেক বেশি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংক সেবা পৌঁছে গেছে। তার পরও দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির নগদনির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হলে হুন্ডিসহ অবৈধ অর্থ লেনদেন অনেক কঠিন হতো। অর্থের উৎস ও গন্তব্য সম্পর্কে জানা যেত। কিন্তু নগদ প্রবাহ কমানো সম্ভব না হওয়ায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে নগদনির্ভরতা কমাতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে গত সেপ্টেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ফলে যে আমানত জমা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ যাচ্ছে। আবার ডলার কেনা, রেমিট্যান্স কেনা, রপ্তানি বিল নগদায়নে বাড়তি টাকা বের হচ্ছে ব্যাংকগুলো থেকে। ব্যবসায় মন্দার কথা বলে ব্যবসায়ীরাও ঋণ পরিশোধ কমিয়ে এনেছেন। ফলে খেলাপি ঋণও বাড়ছে।

এদিকে এখন এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে কলমানিতে টাকা ধার করতে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। এক বছর আগে যা ছিল ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর সাত দিন মেয়াদের জন্য টাকা ধারে সুদ সাড়ে ১০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও নিয়মিত ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে রেপোর মাধ্যমে টাকা ধার দেওয়া বাড়িয়েছে। প্রয়োজনে বিশেষ তারল্য সহায়তাও দিচ্ছে। এতে সুদহার ধরছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার-সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে। চলতি অর্থবছরের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে ৫০৬ কোটি ডলার। এর বিপরীতে মার্কেট থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, যে কোনো ডিজিটাল লেনদেনে ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ নগদ টাকায় কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। গুটিকয়েক শপিং মল আর হোটেল-রেস্টুরেন্ট বাদ দিলে দেশের কোথাও ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবস্থা নেই। দোকানদাররাও চান লেনদেন নগদে হোক। এ অবস্থায় শিগিগরই নগদ অর্থের চাহিদা কমবে না। আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণের ওপরও শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতিটি লেনদেনে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এভাবে একটি দেশের লেনদেন ব্যবস্থা ডিজিটাল করা সম্ভব নয়। অর্থনীতির স্বাভাবিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, কালো টাকার প্রভাব বাড়লে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণও বেড়ে যায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর দেশে নগদভিত্তিক অর্থনীতির আকার (ক্যাশ বেজড ইকোনমি) দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৪২১ কোটি টাকায়। যদিও ২০১০ সালে বাংলাদেশে নগদভিত্তিক অর্থনীতির আকার ৮০ হাজার কোটি টাকায় ছিল।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *