মানবদেহে কিডনি প্রতিস্থাপন

মানবদেহে কিডনি প্রতিস্থাপন

ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়)
কিডনি আমাদের দেহে ছাকনির ন্যায় কাজ করে। কিডনির মধ্য দিয়ে যখন রক্ত প্রবাহিত হয়, তখন রক্তের দূষিত ও বর্জ্য পদার্থ আলাদা হয়ে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। কিডনি যদি কোনো কারণে সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায় তাহলে এই দূষিত ও বর্জ্য পদার্থ শরীরে জমা হতে থাকে এবং তা শরীরে নানা জটিলতা তৈরি করতে থাকে। তখন কৃত্রিম উপায়ে তা শরীর থেকে বের করার ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডায়ালাইসিস। সেই রোগীকে তখন সারা জীবন ডায়ালাইসিস এর মাধ্যমে বেঁচে থাকতে হয়। সপ্তাহে সাধারণত ২ থেকে ৩ বার ডায়ালাইসিস নিতে হয়। তবে ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়ার বিকল্প হিসেবে রোগীর শরীরে কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির সুস্থ কিডনি নিয়ে এসে প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমেও সেই কাজটি করা সম্ভব।
যে ব্যক্তি কিডনি দান করেন তাকে বলা হয় ডোনার (Donor)। এই ডোনার দুই ধরনের হতে পারে।
১) লিভিং ডোনার (Living donor)
২) ক্যাডাভারিক ডোনার বা ডিসিস্ড ডোনার (Deceased donor)
একজন সুস্থ মানুষের দেহে দুইটি কিডনি থাকে। একজন সুস্থ ব্যক্তি যখন কোনো কিডনি বিকল রোগীকে তার একটি ভালো কিডনি দান করে দেন, সেই ডোনারকে বলে লিভিং ডোনার। এই অবস্থায় বাকী জীবন সেই লিভিং ডোনার একটি কিডনি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন।


অপরদিকে কোনো ব্যক্তির মস্তিষ্ক কোনো অসুস্থতার কারণে স্থায়ীভাবে বিকল হয়ে যায় সেই অবস্থাকে বলে ব্রেইন ডেথ (Brain death)। কোনো রোগীর ব্রেইন ডেথ হলে সেই অবস্থা থেকে তার আর কখনো ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে না, কেবল মাত্র কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্রের (লাইফ সাপোর্ট যন্ত্রের) মাধ্যমে সে বেঁচে থাকে। এরকম ব্রেইন ডেথ ব্যক্তির শরীর থেকে কিডনি নিয়ে অন্য কোনো কিডনি-বিকল রোগীর শরীরে তা প্রতিস্থাপন করা হলে সেই ডোনারকে বলা হয় ডিসিস্ড ডোনার (Deceased donor)।
যেমন- এই বছরের ১৮ই জানুয়ারি দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এদেশে প্রথমবারের মতো একজন ডিসিস্ড ডোনার থেকে কিডনি নিয়ে আলদা দুই জন কিডনি রোগীর শরীরে তা প্রতিস্থাপন করা হয়। একই সাথে তার কর্নিয়া আরও দুইজন রোগীর চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে ডোনার ছিলেন বিশ বছর বয়সী সারা ইসলাম। তিনি ‘টিউবেরাস ক্লেরোসিস’ নামে এক দুরারোগ্য রোগে ভুগছিলেন। এই রোগটির জটিলতার কারণে তার মস্তিস্কে অস্ত্রপ্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্ট নেওয়া হয়। সেই অবস্থায় তার ব্রেইন ডেথ হয়। মৃত্যুর পূর্বে সারা ইসলাম তার কিডনি ও কর্নিয়া দানের ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার পরিবারের সম্মতিতে সারা ইসলামের শরীর থেকে কিডনি ও কর্নিয়া নিয়ে তা অন্য রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।
আমরা জানি যে একজনের দেহের রক্ত যখন আরেকজনের শরীরে দেওয়া হয় তখন রক্ত পরিসঞ্চালনের পূর্বে উভয় ব্যক্তির রক্তের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তেমনিভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের পূর্বেও কিডনি দাতা ও কিডনি গ্রহিতা উভয়ের রক্তের বেশ কিছু পরীক্ষা করে দেখা হয় যে রোগীর শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা যাবে কিনা।
আমাদের দেশের অঙ্গ সংযোজন আইন অনুযায়ী নিকট আত্মীয় ব্যতিত অন্য কেউ কিডনি দান করতে পারে না। এই আইনটি মূলত লিভিং ডোনারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু ডিসিস্ড ডোনার এর ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এই আইন শিথিল। সেক্ষেত্রে আত্মীয় এর বাহিরে যে কেউ ডিসিস্ড ডোনার হিসেবে কিডনি দান করতে পারে।


কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে একজন ডোনারের শরীর থেকে কিডনি বিচ্ছিন্ন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিডনি-বিকল রোগীর শরীরে তা প্রতিস্থাপন করতে হয়। অন্যের কিডনি যখন কারও শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয় তখন কিডনি রোগীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সেই প্রতিস্থাপিত কিডনির বিরদ্ধে কাজ শুরু করে এবং এতে প্রতিস্থাপিত কিডনির ক্ষতি হয়। এজন্য কিডনি প্রতিস্থাপনের সময় বিভিন্ন ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দমিয়ে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে সেই রোগীকে সারা জীবন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় এমন ঔষধ এর উপর চলতে হয়। প্রতিস্থাপিত হওয়া এই কিডনি যে সারা জীবন কার্যকর থাকে তা নয়। সময়ের সাথে সাথে তার কার্যকারিতাও কমতে থাকে। প্রতিস্থাপিত কিডনি সাধারণত প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর কার্যকর থাকে। তারপর অন্য আরেকজন ডোনারের কাছ থেকে আরেকটি কিডনি তার শরীরে আবার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পরে অথবা তাকে আবার ডায়ালাইসিসের উপর চলতে হয়।
[লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য); সহকারী রেজিস্ট্রার, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *