মহামিলনের অভিযাত্রী মাওলানা রুমি

মহামিলনের অভিযাত্রী মাওলানা রুমি

সাইফ ইমন
ফারসি সাহিত্যে একটি প্রবাদ আছে- সাতজন কবির সাহিত্যকর্ম রেখে যদি বাকি সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফারসি সাহিত্য টিকে থাকবে। এই সাতজন কবির একজন হলেন মাওলানা রুমি (রহ.)। অপর ছয়জন কবি হলেন ফেরদৌসী, হাফিজ, নিজামী, শেখ সাদি, রুদাকি এবং কবি জামি। সুফিসাহিত্যের অন্যতম কর্ণধার ভালোবাসার কবি জালালউদ্দিন রুমি (রহ.) তাঁর কবিতায় বলেন, আমি তো মহামিলনের মহাযাত্রার অভিযাত্রী।


প্রেমের কবিতায় বিশ্ববিজেতা
কাব্য-সাহিত্যে কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির কাব্যগুলো সমৃদ্ধ চিন্তাধারার এক বিশাল সাগর। সাহসী আর প্রেমময় উচ্চারণের কণ্ঠস্বর এই মানুষটি আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে চলে গেছেন নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু তাঁর ভালোবাসার রাজত্ব আজও শেষ হয়নি। শিল্প-সাহিত্যপ্রেমী মানুষের মনের রাজ্যে তাঁর রাজার আসন প্রতিদিন উজ্জ্বল হচ্ছে। দুনিয়ার মানুষের ভোগের নেশা কেটে যাচ্ছে তাঁর কবিতা আর গানের ছন্দে। তাদের অন্তরাত্মা শান্তির আশায় নেশার পেয়ালা ছেড়ে এ বিশ্বজগতের মহান সত্যের সান্নিধ্য প্রত্যাশী হচ্ছে। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি তাঁর কবিতায় যে দিকদর্শন উপস্থাপন করেছেন তা নিয়ে তাদের গবেষণার অন্ত নেই। তাঁর লেখা কোনো কবিতার বই ইংরেজি অনুবাদ হয়ে বাজারে এলেই বেস্ট সেলার, গীতি কবিতার অ্যালবাম কিনতে বিশাল লাইন পড়ে যায় দোকানের সামনে। বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি কবিদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত। ফারসি ভাষাভাষীদের গবেষকরা জালালউদ্দিন রুমিকে তাদের সবচেয়ে বড় কবি হিসেবে দেখেন। বিশ্বে তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে যে ভালোবাসা আর প্রেমের বার্তা তুলে ধরতে চেয়েছেন তা ভাষা ও জাতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি তাঁর কাব্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দর্শন দিয়েছেন যা সমগ্র মানবজাতির আত্মার রহস্যের বিষয়। কাব্য-সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি গদ্যও রচনা করেছেন। তাঁর গদ্য সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে কিছু সংলাপ, যেগুলোর মানসম্পন্ন অনুবাদ করেছেন এ জে আরবেরি।


মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ.) ত্রয়োদশ শতকের একজন ফারসি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক এবং সুফি দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। তিনি আফগানিস্তানের বলখ শহরে ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পরিবার ছিল বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও ধর্মতত্ত্ববিদ পরিবার। তাঁর পিতা শেখ বাহাউদ্দিন ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত বুজুর্গ আলেম। পিতার সঙ্গে পবিত্র হজ পালনের পর সিরিয়া গমন করেন। শেষ পর্যন্ত পূর্ব রোমে সালজুকি বংশের দ্বাদশতম শাসক, সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের (৬১৬-৬৩৪ হিজরি) আমন্ত্রণে তার রাজধানী বর্তমান তুরস্কের কুনিয়ায় গমন করেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমি তাঁর পিতার কাছেই প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। ২৪ বছর বয়সে পিতার ইন্তেকালের পর তিনি সৈয়দ বোরহান উদ্দিন মুহাক্কেক তিরমিজির সাহচর্য গ্রহণ করেন। সৈয়দ বোরহান উদ্দিন ছিলেন মাওলানা রুমির পিতার শিষ্য। সৈয়দ বোরহান উদ্দিনের পরামর্শক্রমে দেশ সফরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, উচ্চতর জ্ঞান আহরণ ও তরিকতের বুজুর্গদের সাহচার্য লাভের জন্য দামেস্ক সফর করেন। দামেস্কে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতায় পূর্ণতা হাসিলের পর তিনি পুনরায় কুনিয়ায় ফিরে আসেন।


দীর্ঘকাল কুনিয়ায় অবস্থান করেন মাওলানা রুমি। কুনিয়া তখন পূর্ব রোমের অন্যতম নগরী এবং তা রুমিয়াতুছ ছোগরা বা ছোট রুম নামে প্রসিদ্ধ ছিল। মাওলানা রুমি কুনিয়ায় অতি সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা ও অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। এমন সময় এক মহান মাজজুুব অলীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁর জীবনধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। সেই মহাসাধকের নাম শামসে তাবরিজি। সাহিত্যের সামগ্রিক বিচারে রুমির মাহাত্ম্য নিহিত এইখানে যে, তিনি পবিত্রতার নির্যাসটুকু হাজির করতে পেরেছিলেন তাঁর লেখনীতে। যা মানুষকে পবিত্র ও সৌন্দর্যের সন্ধান দেয়। মানব সন্তান সীমাহীন স্বাধীনতা ও অফুরন্ত স্বর্গীয় মহিমা নিয়ে জন্ম লাভ করেছে। এ দুটি পাওয়া মানুষের জন্মগত অধিকার। আর এই অধিকার পেতে হলে অবশ্যই ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। মাওলানা রুমি অত্যন্ত সরাসরি দৈনন্দিন জীবনাচরণ থেকে উদাহরণ টেনে সত্যকে জীবন্তভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। উšে§াচন করতে চেষ্টা করেছেন মানবাত্মার রহস্য। পরম করুণাময়ের ভালোবাসা কীভাবে হাসিল করা যায় তার ওপর অনেক চিত্তাকর্ষক লেখা তিনি লিখেছেন। রুমির জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ১২৪৪ সালে। সে সময় তিনি কুনিয়ায় একজন অতি আশ্চর্যজনক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর নাম শামস আল-দীন তাবরিজ বা শামস-ই তাবরিজ। শামস রুমিকে আধ্যাত্মিক প্রেমের সবক দেন যা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে রুমির মাঝে। শামস-ই তাবরিজ যেন সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি তিনি উপলব্ধি করতে থাকেন, তিনি যেন পরম করুণাময়ের ছায়াতলে আশ্রয় পাচ্ছেন। এমতাবস্থায় এক দিন শামস-ই তাবরিজ নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
আবার অনেকে ধারণা করেন শামস-ই তাবরিজ নিহত হয়েছেন। তবে এরপর থেকে রুমির মনের ভিতরে আমূল পরিবর্তন ঘটে। তাঁর কলম দিয়ে ঝরনা ধারার মতো কবিতা বেরুতে থাকে। রুমি অবশ্য তাঁর অনেক লেখার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। আর বাকি থাকে না যে, তিনি কোন পর্যায়ের আলেম। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ.) ৬৭২ হিজরিতে ৬৮ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে যাত্রা করেন অন্য ভুবনে।


গজল ফারসি সাহিত্যের অনন্য সম্পদ
জালালউদ্দিন রুমির কাব্য ‘দিওয়ানে শামস’ ফারসি গজল সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই গ্রন্থের কাব্যে কাব্যে রচিত হয়েছে হৃদয়জুড়ানো শব্দমালা। যার করুণ রসের অপূর্ব আস্বাদে পাঠক চলে যাবে এক অদেখা-অজানা ভুবনের অচেনা সময়ে। ঠিক যেন মহামিলনের মহাযাত্রার পথিকের দিক-নির্দেশনা এই ‘দিওয়ানে শামস’। ঐতিহাসিক জুল আল আফলাকির মতে, জালালউদ্দিন রুমির শ্রেষ্ঠ বেদনাবিধুর কবিতাগুলো রচিত হয়েছে শামস তাবরিজিকে হারানোর বিরহ ব্যথাকে কেন্দ্র করে। জালালউদ্দিন রুমির আধ্যাত্মিক গুরু শামস তাবরিজি। শামস তাবরিজি নানা দেশে ভ্রমণ করে ধর্ম সম্পর্কে নানা জ্ঞান অর্জন করেন, যা তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করেছেন। তিনি অর্জিত জ্ঞানকে তাঁর সীমার মধ্যে আটকে রাখেননি। ছড়িয়ে দিয়েছেন সবার মধ্যে। সবার সেই একজন হলেন জালানউদ্দিন রুমি। গুরুর জ্ঞানকে নিজের মধ্যে ধারণ করে যিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর গুরুমতই। রুমির রচনাগুলো সূর্যের মতোই প্রজ্জ্বল। ফারসি ভাষাভাষী অঞ্চল ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশে ওয়াজ-নসিহতের মজলিশ এবং জ্ঞানগত আলোচনায় রুমির মসনবি গ্রন্থের শ্লোকগুলো চিরঞ্জীব। রুমির রচনা থেকে বিশ্বব্যাপী উদ্ধৃতি দেওয়ার ব্যাপক প্রচলন আছে। পশ্চিমা বিশ্বে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় তুলে ধরার সময় ভারত ও উপমহাদেশের আলেমদের মুখে শোনা যায়, তাঁর মসনবির একটি অমর শ্লোক। শ্লোকে তিনি বলেছেন, ‘মান না গুঞ্জাম দার জামিন ও আসমান লেকেগুঞ্জাম দার কুলুবে মুমিনান’। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, ‘আকাশ ও জমিন আমাকে ধারণ করে না, বরং মুমিনের হৃদয়ই ধারণ করে আমাকে’। মাসনবিতে প্রায় ২৫ হাজার ধ্রুপদী শ্লোক তথা ৫০ হাজার পঙ্ক্তি আছে। যা সাবলীল এবং সব ধরনের কাব্যিক রসে-সৌন্দর্যে ভরপুর। বাংলাভাষায়ও রুমির গ্রন্থগুলো অনুবাদ করা হয়েছে। যা পড়ে মহাকালের অভিযাত্রায় শামিল হতে পারেন যে কোনো বাঙালি।


হযরত শামস-ই তাবরেজ
কল্পনার একীভূতকরণ, শরীর ও মনকে পৃথিবীর সব শক্তির কেন্দ্রবিন্দুর কাছে সমর্পিত করার মাধ্যমে সুফিবাদের আত্মশুদ্ধি পরিপূর্ণতা লাভ করে। সুফি সাহিত্যিক জালালউদ্দিন রুমির লেখার মাধ্যমে হযরত শামস-ই তাবরেজের নাম বিশ্বব্যাপী আমরা জানতে পারি। রুমি যখন তুরস্কের কোনিয়ায় মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন তখন বিশ্বব্যাপী হযরত রুমির নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আধ্যাত্মিক চর্চা করতেন। একদিন পথে এক জীর্ণ পোশাকধারী ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান। সে ব্যক্তির প্রশ্ন ছিল- হে রুমি, ইমানের সংজ্ঞা কী? হযরত রুমি নানাভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন ইমানের সংজ্ঞা। কিন্তু সেই জীর্ণ পোশাকধারী ব্যক্তি তার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বললেন, রুমি, ইমানের সংজ্ঞা হচ্ছে, নিজের থেকে নিজেকে পৃথক করে ফেলা। তার উত্তর শুনে হযরত রুমি তাঁর অনুগত হয়ে গেলেন। তিনি হযরত শামস-ই তাবরেজ। যার সঙ্গে রুমি গভীর ধ্যান সাধনায় লিপ্ত থাকতেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, হযরত শামস-ই তাবরেজের সঙ্গে খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল। জালালউদ্দিন রুমি যখন হযরত শামস-ই তাবরেজের সংস্পর্শে সংসারের প্রতি মনোসংযোগ হারিয়ে ফেললেন, তখন সবাই পরিব্রাজক হযরত শামস-ই তাবরেজকে দায়ী করেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে কয়েকজন হিংস্র মানুষ হযরত শামস-ই তাবরেজকে হত্যা করেন। জালালউদ্দিন রুমি (রহ.) তাঁর বিখ্যাত পুস্তক দিওয়ানে শামসে তাবরেজ তার গুরুকে হারানোর যন্ত্রণার কথা বর্ণনা করেছেন। এই বইটি পাঠ করলে অবশ্যই বুঝতে পারবেন গুরু-শিষ্যের মধ্যে পবিত্র আধ্যাত্মিক বন্ধন ভেঙে গেলে একজন প্রেমিক শিষ্য কী যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকেন। একই যন্ত্রণার কথা তিনি মালাকাতে শামসে তাবরেজ পুস্তকে বর্ণনা করেছেন। হযরত শামস-ই তাবরেজ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ছিলেন সেই সময়ের আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট। তিনি নির্জনতা প্রিয় ছিলেন এবং একা ছিলেন। পরিব্রাজক ছিলেন বলে তাকে পারিন্দা বলা হতো। তিনি এক জায়গায় স্থির থাকতেন না। তাঁর সমাধি রয়েছে তুরস্কের তাবরেজ নগরীতে।


মানবপ্রেমের বাঁশিওয়ালা…
হযরত জালালউদ্দিন রুমি (রহ.) তাঁর কাব্যে কল্পনা, বাস্তবতা, প্রেম, আধ্যাত্মিকতা, শিক্ষা, রহস্য, রূপকথা ও উপদেশসহ সব বিষয়েই স্পর্শ করেছেন। তাঁর নানান লেখায় একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট; আর তা হলো মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম। আর এটাই আয়োজন প্রায় ৮০০ বছর পরও তাকে অত্যুজ্জ্বল করে রেখেছে বিশ্বসাহিত্যে। তাঁর রচনা মসনবি সম্পর্কে ইরানের বিখ্যাত কবি আবদুর রহমান জামি বলেছেন, ‘মাসনাবিয়ে মানাবিয়ে মৌলাভি, হাস্তে কোরআন দার জবানে পাহলাবি’। অর্থাৎ মৌলভীর আধ্যাত্মিকতা মসনবি কাব্যটি হচ্ছে ফারসি ভাষার কুরআন। যদিও ঐশ্বরিক বাণী কুরআনের সঙ্গে তুলনা করার মতো কোনো মহাগ্রন্থ বিশ্বে নেই এবং তেমন গ্রন্থ রচনা করা মানুষের সাধ্যাতীত। জালালউদ্দিন রুমির মসনবিতে কুরআনের শিক্ষার ব্যাপক প্রতিফলন দেখা যায় বলেই মনে হয় কবি আবদুর রহমান জামির এ মন্তব্যটি করেছেন।
গবেষকরা বলেন, কাব্য-সাহিত্যে তাঁর শব্দগুলো যেন গলিত লোহার টুকরোগুলোর মতোই কিংবা রং-বেরঙের পাথরের নুড়ি দিয়ে তৈরি করা মোজাইক টাইলসের মতো চকচকে। পাশ্চাত্যের কোনো একজন কবি বলেছিলেন, ‘কবিতার জগতে তাই মধুরতম হয়, যা মানুষের বেদনার কথা বলে।’
বিশ্ব প্রেমের সাধনায়…


আধ্যাত্মিক সাধনা
বিশ্বব্যাপী জালালউদ্দিন রুমির খ্যাতি ও পরিচিতির মূলে হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ মসনবি। এতে রয়েছে সুফিদর্শন ও আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য লাভের পথ-নির্দেশনা। সুফিতত্ত্ব রুহ বা আত্মার প্রকৃতি, জীবন-মৃত্যু ও জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ রকম প্রতিটি বিষয়ের অভিব্যক্তি রয়েছে এ মসনবিতে।
বাস্তব ও কল্পিত কাহিনি, উপকথা, নীতিগল্প, রূপক কাহিনি ও গভীর চিন্তাধারার সমাহারে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিষয়সমূহ হয়ে উঠেছে সহজবোধ্য ও সাবলীল। বৈষয়িক ভোগ-বিলাস, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতির অনীহা সৃষ্টি এবং পারলৌকিক জীবনের প্রতি অনুগামী করে তুলতে অনুপ্রেরণার উৎসমূল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে এ মসনবি শরিফ। যা মুসলিম বিশ্বের সাহিত্য সাধনা, ইসলামি সংস্কৃতি ও দর্শনের বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ। মাওলানা রুমির ২২ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই মসনবি শরিফ।
যা সুবিশাল ৪০ হাজার লাইনের একটা মহাজ্ঞানের সমাহার। তুরস্কের কুনিয়া শহরে তাঁর সমাধি বিশ্বের আল্লাহ প্রেমিকদের জিয়ারতগাহ। হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষ মাওলানা রুমির কিতাব নিজস্ব আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য পাঠ করে থাকেন।


সুফি দর্শন
ফারসি সাহিত্যাঙ্গনে যাঁর আলোকচ্ছটায় বিশ্বসাহিত্যে গৌরবান্বিত জালালউদ্দিন রুমি তাঁদের অন্যতম। শামস-ই তাবরেজের সান্নিধ্য তাঁকে আধ্যাত্মিকতার পথ পরিভ্রমণে অনুপ্রাণিত করে। কালের আবর্তনে জালালউদ্দিন রুমিই হয়ে ওঠেন ফারসি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সুফিকবি। আলোড়িত করেন কালের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের মননকে। রুমি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় পশ্চিম তুরস্কের কুনিয়ায় অতিবাহিত করেন।
১২৩০ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুতে স্বীয় ওস্তাদ সাইয়্যেদ বুরহানউদ্দিনের সংস্পর্শে এসে আধ্যাত্মিকতার পথে ধাবিত হতে থাকেন। জালালউদ্দিন রুমির কাব্যপ্রতিভা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী দুজন খ্যাতিমান কবি হাকিম সানায়ি ও ফরিদউদ্দিন আত্তারের প্রভাব অপরিসীম। ফারসি সাহিত্যে সুফিদর্শনের বিকাশে সানায়ি ও আত্তারের ধারা অনুসরণ করেই রুমি কাব্যচর্চা ও সুফিদর্শন পূর্ণতাদানে ভূমিকা রাখেন।
স্বীয় জীবনে তাঁদের প্রভাব সম্পর্কে রুমি বলেন, ‘আত্তার ছিলেন প্রাণ এবং সানায়ি তাঁর দুটি চক্ষু; আমরা আত্তার ও সানায়ির পদাঙ্ক অনুসরণ করে এসেছি।’ অধ্যাপক নিকলসনের মতে, ছয় খন্ডের পূর্ণাঙ্গ মসনবিতে সর্বমোট ২৫ হাজার ৬৩২টি পঙ্ক্তি রয়েছে।


মেভলভিদের সুফি নৃত্য
সুফিবাদ মানুষের হৃদয়কে মহাজাগতিক সম্পর্কের দিকে ধাবিত করে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা অনেক বড় বড় শহরের গঠন, স্থাপত্যিক নকশা এমনকি সংগীতের মৌলিক ধারা- এসব কিছুর সঙ্গে মহাবিশ্বের বিন্যাসের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। অনেকের দাবি অনুযায়ী সুফি নৃত্যের সঙ্গে রয়েছে মহাজাগতিক বিন্যাসের অদ্ভুত সম্পর্ক। বিখ্যাত ফারসি কবি এবং দার্শনিক রুমির জীবনাচরণ জানতে শুরু করলেই আপনার সুফি নৃত্যের প্রতি কৌতূহল, বিস্ময় আর ভালোলাগা তৈরি হবে। অনেকে মনে করেন, রুমি বিশ্বাস করতেন- সংগীত, কবিতা এবং নাচ পরম করুণাময়ের কাছে পৌঁছানোর একেকটি পন্থা। তাঁর এই বিশ্বাসের পথ ধরেই কালক্রমে সুফি নৃত্য অনুশীলন থেকে অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। সুফি নৃত্যের সূচনা করেন রুমি ভক্তরা যারা মেভলভি নামে পরিচিত। এটি নিজস্ব ভঙ্গিতে পরিচালিত হয় সুফি নৃত্যশৈলী। শুরুতেই একজন দরবেশ অন্য একজন দরবেশের সামনে এসে চোখে চোখ রেখে সম্মান প্রদর্শন করেন। এরপর একজন গুরু মনোনীত করা হয়, যাকে অনুসরণ করে অন্যরা নিজেদের পথ খুঁজে পাবে। এভাবেই এগিয়ে চলে সুফি নৃত্য।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *