বেহাল চিকিৎসায় রোগী বিদেশমুখী

বেহাল চিকিৎসায় রোগী বিদেশমুখী

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: চিকিৎসার জন্য ফের বিদেশমুখী ভিড় বেড়েছে। ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দূতাবাস-হাইকমিশনে মেডিকেল ভিসার জন্য মানুষের ভিড় বাড়ছে। দেশের সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, সংকট, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। বেসরকারিতে রয়েছে আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। উচ্চবিত্তের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা এসব কারণ আরও উসকে দিচ্ছে। ভালো সেবার আশায় মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষও ছুটছে বিদেশ।

গত জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, একক দেশ হিসেবে ভারতেই ক্রেডিট কার্ডে সবচেয়ে বেশি খরচ করেন বাংলাদেশিরা। বস্তুত দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডে মোট খরচের ৪ ভাগের ১ ভাগ হয় ভারতে। চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতে ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ৭৩ কোটি টাকা খরচ করেছিলেন। মার্চে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৩ কোটি। এর বড় একটি অংশ খরচ হয়েছে চিকিৎসা খাতে। চিকিৎসার জন্য যাওয়ার সময় রোগীরা খরচ মেটাতে ডলার, ইউরো কিনছেন। এতে চাপ বাড়ছে ডলার, ইউরোর বাজারেও। রোগীদের বিদেশমুখী স্রোত শুরু হলেও দেশের সেবার মান উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। রোগে আক্রান্ত হলে উচ্চবিত্তরা যান সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। আর মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তরা সাধ্যের মধ্যে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করান।

গত মে মাসে এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা জানান, গত বছর বাংলাদেশিদের জন্য ১৫ লাখের বেশি ভারতীয় ভিসা দেওয়া হয়েছিল, যা ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে¦ রেকর্ড। ভিসা কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলছে, এ কথা জানিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার আরও বলেন, দ্রুত ও সহজে ভারতীয় ভিসা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশিরা মূলত চিকিৎসা ও ভ্রমণের জন্য ভারতে বেশি যান।

গত মঙ্গলবার ভারতীয় ভিসা সেন্টারের সামনে গিয়ে দেখা যায় মানুষের দীর্ঘ লাইন। ভ্রমণ ভিসার পাশাপাশি বড় একটি অংশ মেডিকেল ভিসার জন্য আবেদন করতে এসেছেন। লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাড্ডার সাইফুল ইসলাম। স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে যাবেন চিকিৎসা করাতে। তিনি বলেন, ‘গত বছর আমার স্ত্রীর পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। চিকিৎসক কিছু টেস্ট দেন। ওষুধ দিলে সেগুলো খাওয়ানো শুরু করি। কিন্তু ব্যথার উপশম হচ্ছিল না। অন্য ডাক্তার দেখালে বলেন লিভারে ইনফেকশন হয়েছে। সেখানেও চিকিৎসা করিয়ে খুব বেশি উন্নতি না হওয়ায় ভারতে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
জানা যায়, উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। একই চিকিৎসা বাংলাদেশে করতে যে ব্যয় হয়, তা করতে ভারতে খরচ প্রায় দ্বিগুণ। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে ৩ থেকে ১০ গুণ। তবে হাসপাতালের বিল, কেবিন খরচসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচাপাতি হিসাব করলে খরচ প্রায় কাছাকাছি হয়ে আসে। যার কারণে স্থানীয় হাসপাতালগুলোর প্রতি অনীহা বেড়েই চলেছে দিন দিন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘দেশের মানুষ নানা কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এর মধ্যে মানসিক আস্থার সংকট অন্যতম। আবার ১৬ কোটি মানুষের জন্য যত ভালো মানের হাসপাতাল থাকার কথা, তা সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে নেই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেকে প্রতিবেশী দেশে যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশে মানুষ বেড়াতেও যান। আবার অনেকে চিকিৎসাও করিয়ে আসেন। একসঙ্গে দুই কাজ হয়। আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় প্রযুক্তির উন্নয়ন তেমন ঘটেনি। কাজেই রোগীরা বিদেশমুখী হন। কারণ শরীরটা তার নিজের। রোগী যদি মনে করেন এখানকার চিকিৎসা ভালো না, তাহলে বিদেশ যাবেনই। আসলে এটা রোগীর চিন্তাভাবনার ওপর নির্ভর।’


বাথরুমে পিছলে পড়ে হাত ভেঙে গিয়েছিল ব্যবসায়ী সমীর সাহার (৫২)। তিনি বলেন, ‘পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলে এক্স-রে করিয়ে রাজধানীর উত্তরায় একজন সার্জনের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি এক্স-রে দেখে বললেন আমার হাতে অপারেশন করে স্টিলের পাত বসাতে হবে। আমি থাইল্যান্ডের হাসপাতালে গেলে তারা আগের ব্যান্ডেজ কেটে প্রযুক্তির সাহায্যে হালকা কিছু চিকিৎসা করে পুনরায় ব্যান্ডেজ করে দেন। মাত্র দুটি ওষুধ দিয়েছিলেন। ব্যান্ডেজ কাটার পর কিছু ব্যায়াম করতে বলেছিলেন। আমার হাত এখন পুরোপুরি ঠিক। সেখানে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহার খুবই আন্তরিক। অথচ দেশের হাসপাতালে দায়িত্বরত লোকজনের ব্যবহার দেখলেই ভয় লাগে।’ বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণকারী বেশ কয়েকজন রোগীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশে চিকিৎসাসেবার ওপর তাদের আস্থা নেই। ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আর চিকিৎসাসেবায় রয়েছে সংকট। চিকিৎসক ও নার্সদের আচরণ রোগীবান্ধব নয়। এ দেশে ক্যান্সার, নিউরো, কিডনি, লিভারসহ কিছু জটিল অসংক্রামক রোগের পূর্ণাঙ্গ বা চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাসেবা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোগীর সর্বোত্তম সেবা ও নিরাপত্তা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার প্রধান কাজ। তবে বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালে রোগীদের সেবার চেয়ে ভোগান্তিই পোহাতে হয় বেশি। প্রয়োজন না থাকলেও দীর্ঘ সময় রাখা হয় আইসিইউতে। এর ওপর লাইসেন্সবিহীন নামসর্বস্ব হাসপাতালে অপচিকিৎসা তো রয়েছেই। হৃদরোগীদের হার্টের রিং পরাতে চলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মন কষাকষি। কিডনি, লিভার প্রতিস্থাপনে রয়েছে নানা জটিলতা। সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংকট, বেসরকারি হাসপাতালের লম্বা সিরিয়াল এবং অব্যবস্থাপনা রোগীদের বিদেশমুখী হতে বাধ্য করে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *