বিপৎসীমায় বাণিজ্য ঘাটতি

বিপৎসীমায় বাণিজ্য ঘাটতি

অর্থ ডেস্ক: অস্বাভাবিক বাণিজ্য ঘাটতির কারণে দেশের অর্থনীতি এখন বিপৎসীমায় আছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩.৫ শতাংশ বাণিজ্য ঘাটতি, যা বিপৎসীমায়।
ক্রমবর্ধমান এই বাণিজ্য ঘাটতি যদি জিডিপির ৪ শতাংশ হয়, তাহলে শিগগিরই অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।

গত রবিবার রাজধানীর একটি হোটেলে পিআরআই আয়োজিত ‘রিয়েলাইজিং ডেভেলপমেন্ট এসপিয়েরেশন উইথ ডমেসটিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন অ্যাডমিট ম্যাক্রো ইকোনমিক চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনাসভায় এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেন ওই বেসরকারি গবেষণা সংস্থাটির চেয়ারম্যান জাহেদী সাত্তার।
মূলত আমদানি ব্যয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কম হলে যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।
মূল প্রবন্ধে পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশের যে বাণিজ্য ঘাটতি, তার অন্যতম প্রধান কারণ আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। এ ছাড়া আমাদের অর্থনীতিতে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ সংকট। এর পেছনে বৈশ্বিক কারণও রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, আমাদের রিজার্ভের সংকট-সব কিছুর কারণে আমাদের আজকের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।’ তিনি বলেন, ‘গত ৫০ বছরে আমাদের অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। তবে আমাদের মানবসম্পদের তেমন উন্নয়ন হয়নি। আমাদের প্রায় এক মিলিয়ন লোক দেশের বাইরে আছে, কিন্তু তাদের বেশিরভাগই বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে না। তার একটা প্রভাব পড়বে রিজার্ভে।’

তিনি বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে আমাদের তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এক. মূল্যস্ফীতি, দুই. বাণিজ্য ঘাটতি, তিন. বৈদেশিক ঋণ। এই তিনটি চ্যালেঞ্জকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে নানামুখী কাজ করতে হবে।’
জাহেদী সাত্তার পরামর্শ দেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি জোর দিতে হবে আমদানিজনিত পণ্যের ব্যয় কিভাবে কমানো যায়, তার ওপর। প্রয়োজনে আমদানি পণ্যের শুল্ক কমাতে হবে।’

বাণিজ্য ঘাটতির আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে আমরা অনেক ভালো অবস্থানে আছি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ৫.৬ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরে ছিল চার বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। বৈদেশিক বিনিয়োগ গত অর্থবছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ২৫০ মিলিয়ন ডলার, যা এই অর্থবছরে ৩৬০ মিলিয়ন ডলার।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গত অর্থবছরের তুলনায় অনেক ভালো। তবে আমাদের মূল্যস্ফীতি অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে আমাদের খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। সেটা হয়েছে আমদানির কারণে। তা ছাড়া শুধু আমাদের দেশে নয়, গোটা বিশ্বের মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার কাজ করছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর পাশাপাশি কৃষিজাত পণ্য আমদানি সহজ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে, বিশেষত রেমিট্যান্স আহরণের ওপর প্রণোদনা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো প্রবাসীদের সুবিধা দেওয়া। এর মাধ্যমে মূলত দেশের একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ইউনিফায়েড বা একক বিনিময় হারের দিকে যেতে হবে।

অর্থনীতিবিদ এম এ রাজ্জাক তাঁর প্রবন্ধে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। কিন্তু উন্নত অর্থনীতির দেশের পর্যায়ে যেতে হলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বা রাজস্ব আয় বাড়ানোটা খুব জরুরি। ’
সমাপনী বক্তব্যে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা আমাদের সংকট ও চ্যালেঞ্জগুলো জানি। আমার বাড়িঘর রক্ষার দায়িত্ব আমার। বাইরে থেকে ঝড় আসবে সেটাকে আমাকেই রক্ষা করতে হবে। একটা অর্থনীতির ঝড় এসেছে। তবে আমাদের যা করণীয়, আমরা তা করতে পারিনি। ’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্পদ অর্জনের নতুন নতুন ক্ষেত্র ছাড়া উন্নত দেশ হওয়া সম্ভব। সরকারকে কৃষিতে নজর দিতে হবে। কেন আমাদের ৫ শতাংশ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সারের দাম কমিয়ে কৃষকদের মধ্যে তা বিতরণ করতে হবে এবং কৃষিকে প্রযুক্তিবান্ধব করতে হবে। ’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) এক হাজার ২৬৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ৮১৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। এতে ৪৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *