বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

নাজনীন বেগম: বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃষ্টিনন্দন হলেও হরেক বিপত্তি মাথাচাড়া দেওয়া পরিবেশ পরিস্থিতির নির্মম শিকার। সেই পুরনো সামাজিক ব্যাধি, বাল্যবিয়ে আজও সংশ্লিষ্টদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিদ্যাসাগর যখন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক অভিশাপ আর আবর্জনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন সেখানে তিনি বাল্যবিয়ে রোধের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। শুধু বাল্যবিয়ে বন্ধ নয় প্রতিষেধক হিসেবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন নারী শিক্ষাকেও। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়াও উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন অবোধ বালিকাদের যেন বিয়ের পিঁড়ি অবধি যেতে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে জোর দেওয়া হয়।
তিনি বললেন, একজন কন্যা শিশুকে বিয়ে দিতে যা খরচ হয় তার অর্ধেক করলে বালিকাটি শিক্ষা অর্জনে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। যা পরবর্তীতে তার চলার পথ সুস্থির করতে নিয়ায়ক ভূমিকা রাখে। এমন সব অমৃত বার্তা আমাদের সমাজকে সেভাবে আলোকিত করতে পারেনি। তাই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বাল্যবিয়ে নামক চিরায়ত ব্যাধিটি আজ অবধি সংশ্লিষ্টদের নাজেহাল করে তুলছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ দক্ষিণ এশিয়ায় কন্যা শিশুর অকাল বিয়ে সংক্রান্ত এক গবেষণালব্ধ তথ্য উপস্থাপন করে। তাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিয়ের তথ্য-উপাত্তে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শীর্ষে।

সমাজের সমসংখ্যক নারী শিশু বয়স যদি এমন অপরিণামদর্শিতায় আবর্তিত হয় তাহলে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কিভাবে তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাবে? আমাদের দেশে ৫১% মেয়ের বিয়ে হয় শিশু এবং কিশোরী বয়সে। যা অবধারিতভাবেই উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাকে যথার্থ গন্তব্যে পৌঁছাতে বহুদূর পিছিয়ে দেবে। আবার বিশে^র মধ্যে এই বাল্যবিয়ের জায়গায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। এখানেও আমরা স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিতে নেই।
৬ কোটি ৪৫ লাখ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। তার মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের নিচে। অসহনীয় এক চিত্র দেশের জন্য। যে কোনো সমাজ নিজস্ব কৃষ্টি, ঐতিহ্য সামাজিক মূল্যবোধ এবং চিরায়ত সংস্কারে আবদ্ধ থাকে। আধুনিকতার নতুন স্রোতে দীর্ঘদিনের অপসংস্কার বিলুপ্ত হওয়াও সময়ের অনিবার্য দাবি। কিন্তু সেই বিদ্যাসাগর কিংবা বেগম রোকেয়া থেকে সোচ্চার হওয়া পথিকৃৎরা আজ অবধি তাদের মূল্যবান বার্তা কেন বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হলেন তেমন প্রশ্ন সচেতন গবেষকদের উদ্বিগ্ন এবং উৎকণ্ঠিত করে। সময়ের স্রোতে পুরনো বিধিবদ্ধ সংস্কার নতুন আঙ্গিকে সমাজকে আলোকিত করবে সেটাই কাঙিক্ষত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট ঠিক তার উল্টো। বিদ্যাসাগর এবং বেগম রোকেয়া বাল্যবিয়ে রোধে আবশ্যিক পূর্বশর্ত হিসেবে নারী শিক্ষাকেও সর্বাধিক গুরুত্ব বিবেচনায় আনেন।

নারী শিক্ষা একেবারে পিছিয়ে আছে এমনটা বলাও মুশকিল। সমসংখ্যক এই অংশ শুধু শিক্ষা নয় বিভিন্ন পেশায়, কর্মদক্ষতায় এগিয়ে যাওয়ার চিত্রও উঠে আসছে। তবে গবেষণা প্রতিবেদনে যা দৃশ্যমান হয় তাতে বলা যায় সংখ্যায় তারা এত অপ্রতুল যা দেশের নেতিবাচক চিত্রকেই উপস্থাপন করছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকে একজন শিশু কন্যার বিয়ের পিঁড়িতে বসা মানেই তার নিজেকে তৈরি করার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা শেষ হয়ে গেল। সেখানে ভর করবে অকাল মাতৃত্ব, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়া ছাড়াও উন্নয়নের ধারাবাহিক প্রকল্পও পদে পদে হোঁচট খাবে।
ইউনিসেফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অভিমত- বাংলাদেশের দৃশ্যমান অগ্রগতি সত্ত্বেও শিশু বধূর সংখ্যা সত্যিই বিস্ময়কর। অসংখ্য শিশুকন্যার শৈশব হরণ করা ছাড়াও জীবন গড়ার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে এই অপরিণত বিয়ে। এখানেও বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে শিশু কন্যার শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। যার গুরুদায়িত্ব বর্তায় সমাজের আদি ও অকৃত্রিম প্রতিষ্ঠান পরিবারের ওপর। মেয়েকে শিক্ষিত করার বিষয় সবার আগে ভাবতে হবে পিতা-মাতাকে। কারণ বাল্য বয়সে সন্তান নিজেও বোঝে না কোনটা তার জন্য বিশেষ জরুরি। অন্তত প্রাইমারি ও মাধ্যমিক পর্যন্ত বাবা-মার সচেতন তত্ত্বাবধানে মেয়েরা লেখাপড়ার সঙ্গে জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হবে এটাই সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বের সঙ্গে বুঝতে হবে।


শিশু কন্যাটি যখন পরিপূর্ণ তরুণীতে নিজেকে আবিষ্কার করবে তাহলে তাকেই যথার্থ পথ বেছে নেওয়ার সুযোগও দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে বিয়ের পর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ এতটাই কম মেয়েরা সংসার ছাড়া অন্য কিছু ভাবাও মুশকিল হয়ে যায়। এরই মধ্যে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তা একেবারে হাতে গোনার অবস্থায়। বাল্যবিয়ের সঙ্গত কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয় জলবায়ু সংকট এবং ২ বছরের করোনা মহামারির দুর্ভোগ। এই অতিমারির নেতিবাচক প্রভাব কাটাতে মূল্যবান অর্জনগুলো যেন সুদূরপরাহতের দিকে মোড় নিলে পরিস্থিতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে সময় নেবে না। বিয়ের কনে নয় বরং শিক্ষার্থী হিসেবে কন্যা শিশুদের তাদের যথার্থ আসনে বসাতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।
তা না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা এগিয়ে না যাওয়ার আশঙ্কা পদে পদে।
আমাদের বাংলাদেশের শিশুকন্যা বিয়ের করুণ চিত্র সত্যিই মর্মাহত হওয়ার মতো। একটু আলোকপাত করতে চাই ‘বাল্যবিয়ে নিরোধ’ সম্পর্কিত আইন নিয়েও। তবে কবি গুরুর একটি মূল্যবান বার্তা স্মরণ করাও বিশেষভাবে দরকার। তাঁর মতে যে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে পারে না আইন, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম কারোর মাধ্যমে সে সুরক্ষিত থাকবে না। এমন দৃষ্টান্তও প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত হবে।
যুগ যুগ ধরে চলে বাল্যবিয়ে রোধের ওপর প্রথম আইন পাস হয় উপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতে ১৯২৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। এখানে স্পষ্ট করা হয় মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৪ এবং ছেলেদের ১৮ বছর না রেখে আরও বাড়ানোর সুপারিশ আসে। মেয়েদের জন্য ১৮ এবং ছেলেদের বিয়ে হবে ২১ বছরে। ১ এপ্রিল ১৯৩০ সালে আইনটি কার্যকর এবং তা সকলের জন্য বিবেচিত হিসেবে গণ্য হয়। তবে ব্রিটিশ ভারতে এই আইন ছিল নারী আন্দোলনের ফলশ্রুতি। সুতরাং সেভাবে কার্যকর না হওয়ার চিত্রও দুঃসহ।
আমাদের বাংলাদেশ ২০১৭ সালে উপনিবেশিক আইনের জায়গায় সংশোধনী এনে নতুন কার্যক্রম সম্পৃক্ত করে। নতুন এই ধারায় বিয়ের বয়স বাড়ানো হয়নি মেয়ে ছেলে উভয়ের ক্ষেত্রে। তবে এক বিষ ফোঁড়া যেন নতুন আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এগিয়ে এলো। সেখানে উল্লেখ থাকে বিশেষ প্রয়োজন কিংবা সর্বোত্তম স্বার্থে নির্ধারিত বয়সের আগেই আদালতের নির্দেশ এবং বাবা মার সম্মতিতে অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলেমেয়ের বিয়ে হতে পারবে। এই ধারার আলাদা এক ব্যবচ্ছেদের কোনে াসুরাহা তো হয়ইনি বরং যে কোনো শিশুর বিয়ে দেওয়াটা ন্যায্যতা পেয়ে গেল।


বলা যায় আইনও কন্যা শিশুর পক্ষে তেমন কোনো বিধি-বিধান রাখতে পেছনে হেঁটেছে। ২০১৭ সালের আইনের সময়কালও ৫ বছর উত্তীর্ণ হয়ে গেল। সমাজ, আইন, রাষ্ট্র সব কিছুর বিবেচনায় ইউনিসেফের এই গবেষণা যথার্থ এবং বাস্তবসম্মত হিসেবে মানতে অসুবিধা হলেও এটাই সত্যি। তবে কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনায় কন্যা শিশুরা নিজেরই বাল্যবিয়ে ঠেকাচ্ছে। পাশাপাশি অনেকেই জোর কদমে এগিয়েও আসছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ময়মনসিংহের তরুণী সানজিদা ইসলাম ছোঁয়া প্রায়ই শতাধিক বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে সারা বিশ্বকে স্পর্শ করল। বিবিসির ২০২২ সালের প্রভাবশালী নারীর তালিকায় বাংলাদেশের সানজিদার নাম যুক্ত হওয়া এক অপরিমেয় গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা।
ছোঁয়াকে এই দুর্লভ পুরস্কারের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে অধিপরামর্শ ও সক্রিয়তায় বিশেষ অবদানের জন্য। অবশ্যই তা বাল্যবিয়ে রোধ করার দুঃসাহসিক কার্যক্রমে। নিজে এখন ছোঁয়া তার স্পর্শকাতর সময়গুলো পার করছিলেন সামনে এসে যায় মায়ের প্রতিচ্ছবি। মনে হলো মার যদি অল্প বয়সে বিয়ে না হতো তাহলে তিনি লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতেন। তেমন বোধ থেকে ছোঁয়া যেখানে বাল্যবিয়ের সংবাদ পান তার ‘ঘাসফড়িং’ দল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে যান। এই পর্যন্ত শতাধিক বাল্যবিয়ে ঠেকানোর নজির স্থাপনে ছোঁয়া বিবিসির সাংবাদিকদেরও নজর কাড়তে সক্ষম হন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক পুরনো জঞ্জালকে প্রতিহত করতে গিয়ে ছোঁয়া বিশ্ব সভাকেও নাড়িয়ে দেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য আরও ছোঁয়া উঠে আসা জরুরি।
বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে সেটা যেমন ঠিক তাকে আবার কমিয়ে আনাটাও সচেতন দায়বদ্ধতা। যা একেবারে পরিবার, পিতা, মাতা এমনকি কন্যা শিশুটিকেও প্রতিবাদে-প্রতিরোধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আর সেটার জন্য সব থেকে জরুরি নারী শিক্ষা। যা ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিদ্যাসাগর, বিংশ শতাব্দীতে বেগম রোকেয়া এবং আধুনিক প্রযুক্তির বিশ্ব একবিংশ শতাব্দীতেও ইউনিসেফ বলছে। সমসংখ্যক নারীরা যদি কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকে তাহলে সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হতে সময় নেবে না।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *