ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্সে এগোচ্ছে বাংলাদেশ

ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্সে এগোচ্ছে বাংলাদেশ

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার: জনপ্রিয় হচ্ছে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং বাজার। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী-অনলাইনে শ্রমিক সরবরাহে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে এখন দ্বিতীয় এবং মোট অনলাইন শ্রমবাজারের প্রায় ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট অনুযায়ী- শুধু বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররাই বছরে আয় করছেন ১০ কোটি ডলার। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর মতে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ই-কমার্স মার্কেটের সাইজ ছিল ৫৬০ কোটি টাকা। পরের বছর ২০১৭ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬৩২ কোটি টাকায়, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ৫০৪ কোটিতে এবং ২০১৯ সালে ১৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকায়।

ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের তথ্যমতে, ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের ই-কমার্সের মার্কেট সাইজ ছিল ২ বিলিয়ন ডলারের। এরপর করোনাকালীন ২০২১ সালে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ হাজার ৬১৬ কোটি টাকায় পৌঁছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৬০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়। এ বছরের (২০২৩) শেষের দিকে এ লেনদেন ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০২৬ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াবে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলারে (স্ট্যাটিস্টা)। ই-ক্যাবের সদস্য হিসেবে বর্তমানে দেশে প্রায় ১ হাজার ৮০০টি প্রতিষ্ঠান আছে। শুধু ফেসবুককেন্দ্রিক উদ্যোক্তা ৫০ হাজারের ওপরে, ওয়েবসাইটভিত্তিক উদ্যোক্তার সংখ্যা ২ হাজার, ক্রিয়েটিভ ও মাল্টিমিডিয়ায় সম্পৃক্ত আছেন ১৯ হাজার ৫৫২ জন। তবে সামগ্রিকভাবে বর্তমানে দেশে ৫ লাখেরও বেশি ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায়িক পেজ আছে।


জাতিসংঘের সংস্থা আংকটাডের হিসাবমতে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ৩০ হাজারে এবং ২০১৭ সালে ৩ লাখে উন্নীত হয়। অথচ ২০১৩ সালে বাংলাদেশে মাত্র সাড়ে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ কম্পিউটার ও তথ্যসেবায় কর্মরত ছিলেন। অবশ্য পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালের পর থেকেই বাংলাদেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। ২০১০ সালে আইসিটি খাতে বৈশ্বিক কর্মসংস্থান ৩ কোটি ৪০ লাখ থাকলেও ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯০ লাখে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২ হাজার ৫০০-এরও বেশি ই-কমার্স রয়েছে, যার মধ্যে ১ শতাংশ বড় প্রতিষ্ঠান, ৪ শতাংশ মাঝারি এবং ৯৫ শতাংশই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী- ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে কার্ডের মাধ্যমে ই-কমার্স লেনদেনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪০৬ কোটি, ৭৭৮ কোটি ও ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। শুধু গত এক বছরেই দেশের ই-কমার্স খাতে প্রায় ১ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে এবং বিগত ১৪ বছরে বাংলাদেশে আইসিটি খাতের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে আইটি/আইটিইএস খাতে ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বর্তমানে ৫২ হাজার সরকারি ওয়েবসাইট রয়েছে এবং এ খাতে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে। ই-কমার্স লেনদেনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৪৬তম। স্পষ্টতই প্রমাণিত, দেশে ফ্রিল্যান্সিং এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে লেনদেন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং এবং ই-কমার্সে লেনদেন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান নিয়ামক হচ্ছে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, ডেটা ট্রান্সমিশনের দ্রুততা, মজুরি কম ইত্যাদি। গ্লোবাল ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) ট্যারিফের বিকল্প হিসেবে তথ্যপ্রবাহ ১৯৯২ সালে দৈনিক ১০০ গিগাবাইটের (জিবি) মতো থাকলেও ২০১৭ সালে প্রতি সেকেন্ডে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার গিগাবাইটে। আরও বেশি মানুষ ইন্টারনেটের সঙ্গে যোগ হওয়ায় ও ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) পরিসর বাড়ায় আইপি ট্র্যাফিক ২০২২ সাল নাগাদ প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭০০ জিবিতে পৌঁছে। এসব টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর সফল নেতৃত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।


এ ছাড়াও ব্লক চেইন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্যাটেন্টগুলোর ৭৫ শতাংশ, আইওটিতে বৈশ্বিক ব্যয়ের ৫০ শতাংশ ও বৈশ্বিক ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের বাজারের ৭৫ শতাংশের বেশি এ দুই দেশের দখলে। সার্বিকভাবে আইসিটি খাতে এ দুই দেশের অবদান প্রায় ৪০ শতাংশ, আর ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের বাজার মূলধনের ৯০ শতাংশই তাদের দখলে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে নিরলস কাজ করছে আইসিটি ডিভিশন। এক্ষেত্রে শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন ও ট্রেনিং সেন্টার এবং তিনটি হাইটেক পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশব্যাপী শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের ব্যাপক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। আইসিটি ডিভিশনের উদ্যোগে দেশব্যাপী শিক্ষিত ও বেকার যুবকদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় ফ্রিল্যান্সিয়ের বিভিন্ন কোর্স যেমন ডাটা এন্ট্রি, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, কনটেন্ট রাইটার, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রচুর অর্থায়ন করা হচ্ছে। অনলাইনে কিংবা নিজে আগ্রহে এসব প্রোগ্রামে দুই-তিন মাসেই ভালো দক্ষতা অর্জন করা যায়। এরপর ফাইবার, আপওয়ার্ক, ফ্লেক্সজবস, ক্লাউডপিপস, গুরু ইত্যাদি মার্কেট প্লেসে নিজের প্রোফাইল আপলোড করলেই হাজার হাজার কাজের তালিকা চোখের সামনে ভেসে আসে।
শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীরা এ ফান্ডের কল্যাণে ফ্রিল্যান্সিং পেশায় ব্যাপকভাবে জড়িত হচ্ছে এবং ঘরে বসেই আয় করছে বৈদেশিক মুদ্রা। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬ লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সার আছে, তন্মধ্যে ১১ শতাংশই নারী (অর্থাৎ ৭১ হাজার ৫০০ জন)। স্বামী-সংসার ম্যানেজ করেই বেশ আয় করছে, অনেকেই হয়েছেন বিশ্বখ্যাত ফ্রিল্যান্সার। এ সাফল্যের পেছনে আছে সহজলভ্য ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট শহর থেকে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায়। তবু এ পেশায় রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ, যেগুলো দ্রুত সমাধানযোগ্য।


যেমন- নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা, কারিগরি জ্ঞান, ল্যাপটপ এবং ডিজিটাল শ্রমবাজারের রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের অভাব ইত্যাদি। এ ছাড়া সময়মতো সঠিক পণ্যের ডেলিভারি নিশ্চিত করা, রিটার্ন পলিসি এবং ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিও বড় চ্যালেঞ্জ। আর উদ্যোক্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল ডিভাইস ও পেপালের মতো পেমেন্ট গেটওয়ের অভাব। ফ্রি ফ্রিল্যান্সারদের বিশেষ সামাজিক মর্যাদা, ভিআইপি সুযোগ-সুবিধা, প্রণোদনা, রাজস্ব ছাড় ইত্যাদি বিবেচনা করা যেতে পারে। সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান হলে ফ্রিল্যান্সিং এবং ই-কমার্সে বাংলাদেশের অবস্থান হবে শীর্ষে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *