দেওয়ানবাগ ডেস্ক: বাংলাদেশে প্রতিদিন ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। দেশের মোট উৎপাদিত বর্জ্যের (৮ লাখ টন) মধ্যে ৮ শতাংশই তৈরি হয় প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে। আর এসব বর্জ্য শেষপর্যন্ত নদী ও সাগরে গিয়ে পড়ে, যা জলজ প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু এই প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ বা রিসাইকেল করার কোনো উপায় নেই। ব্যবহারে বিপদ আছে জানার পরও অধিকাংশ মানুষ প্লাস্টিকে তৈরি পণ্য ব্যবহার করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের মাধ্যমে যে প্লাস্টিক বর্জ্য মানবশরীরে প্রবেশ করে তা ধীরগতিতে বিষক্রিয়া চালায়। সাধারণত কিডনি ও যকৃতের মতো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এতে ক্ষতিগ্রস্তহয়। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তখন সমস্যা তৈরি হবে। দেশে ক্যান্সারের প্রবণতা এ ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে সৃষ্ট রাসায়নিকের কারণেই হচ্ছে। এছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য এর মাধ্যমে যে শুধু নদী-নালা ও খাল বিল ভরাট হচ্ছে তা নয়, এর ফলে পরিবেশের আশপাশে ও বিষ ছড়িয়ে পড়ছে। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) ‘ট্রান্স বাউন্ডারি মুভমেন্ট হ্যাজারডাস প্লাস্টিক ওয়েস্ট: বাংলাদেশ সিচুয়েশন ২০২১’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন বলছে, শুধু পুরান ঢাকাতেই প্রতিমাসে ২৫০ টন প্লাস্টিকের স্ট্র ও খাওয়ার কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য বিক্রি হয়, যেগুলো রিসাইকেল করা যায় না। শুধু খাবারের প্যাকেট ও প্রসাধনী এবং শরীরের যত্নে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্য থেকে ৮২ হাজার ৮২৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। বিশেষ করে টমেটো ক্যাচ আপের পাত্র, শ্যাম্পুর বোতল, কন্ডিশনারের বোতল, টুথপেস্ট টিউব থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। শহর এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্য বেশি উৎপাদিত হয়। গবেষণায় আরও দেখা যায়, শহরে ৭৮ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যের বিপরীতে গ্রামে ২২ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। করোনা মহামারি শুরুর পর প্রথমদিকে দেখা যায় যে, সেসময় দেশে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টনের প্লাস্টিক বর্জ্য (হ্যান্ড গ্লভস, স্যানিটাইজারের বোতল ইত্যাদি) তৈরি হয়েছিল। দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে পোশাক কারখানায় প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগ, হ্যাঙ্গার, গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত সামগ্রী, টেবিল ওয়্যার, কিচেন ওয়্যার, বাক্স, জগ, প্লেট, গ্লাস ও কনটেইনার ইত্যাদি সবকিছুতেই প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া ফার্নিচার, খাবার ও ট্রয়লেট্রিজ পণ্যে ব্যবহৃত প্যাকেটেও প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে। মেডিকেল সামগ্রী, যেমন ব্লাডব্যাগ, স্যালাইন ব্যাগ, ইনজেকশন, মেডিসিন কনটেইনারেও প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে। স্থাপনানির্মাণ সামগ্রী, যেমন প্লাস্টিক পাইপ, দরজা, টয়লেট ফ্লাশ ও প্লাস্টিকে তৈরি। ইলেকট্রিক্যাল ক্যাবলস, সুইচ, রেগুলেটর, কম্পিউটারে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশেও আছে প্লাস্টিক। আবার ছোটছোট প্লাস্টিকের প্যাকেটে তরল জেলি, প্রসাধনী, ওষুধ, খাবার, গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক, চিনি, লবণ, শস্য, মসলা, লোশন, ক্রিম ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে ৩ হাজারের বেশি প্লাস্টিক পণ্যউৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে। এর ৮৯ শতাংশই ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা। এসডোর গবেষণা বলছে, দেশে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মধ্যে বিরাট অংশই ভূমি ও জলাশয়ে গিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক সাধারণত বর্জ্য সংগ্রহকারীরা সংগ্রহ করেন। আর ঢাকার ৩৭ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যই ড্রেন ও সড়কের ওপরে পড়ে থাকে। আর ৩৯ শতাংশ মাটিতেই ফেলা হয়।
সাধারণত প্লাস্টিকের প্যাকেটে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে, যা মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এসডোর সেক্রেটারি জেনারেল শাহরিয়ার হোসেন বলেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার যেহেতু বাড়ছে, এর বর্জ্যের পরিমাণও বাড়ছে। প্লাস্টিকের ‘সিঙ্গেল ইউজের’ পরিমাণ বাড়ছে। সাধারণত সিঙ্গেল ইউজে যে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় তা রিসাইকেল করা যায় না। এর ফলে এই প্লাস্টিক বর্জ্য নদী, খাল-বিল ও জমি সবজায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্লাস্টিকে যেহেতু পেট্রোলিয়াম থাকে এজন্য বলা যায় এটি রাসায়নিক পদার্থ। প্লাস্টিক শুধু একটি প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল নয়, এটি যদি মাল্টিকালার প্যাকেজিং হয় তাহলে এখানে যে রাসায়নিকগুলো ব্যবহার করা হয় সেখানে ১২ থেকে ১৮ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এই ১৮টি রাসায়নিকের মধ্যে ১০টিতেই থাকে উচ্চমাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিক। এই প্যাকেজিংটা যখন আমরা বর্জ্য হিসেবে ফেলে দিচ্ছি তখন তা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক তাপে গলে বা পানিতে মিশে বের হতে পারে। এটি যখন সাগরের পানিতে যাবে তখন তা সোডিয়াম বা লবণের সঙ্গে মিশে দ্রুত বিক্রিয়া করবে। এর ফলে সাগরে দূষণ বৃদ্ধি পাবে। এতে সাগরে থাকা মাছ ও উদ্ভিদ জগৎ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা যদি ফুড চেইনের কথা চিন্তা করি তাহলে এই রাসায়নিক পদার্থ আমাদের খাবারের মধ্যেও চলে যাচ্ছে। যেমন ফসল, মাছ, গৃহপালিত পশু-পাখি থেকেও মানব শরীরে এটি প্রবেশ করতে পারে।