প্রশিক্ষণে স্বাবলম্বী অবহেলিত নারীরা

প্রশিক্ষণে স্বাবলম্বী অবহেলিত নারীরা

বগুড়া সংবাদদাতা: বগুড়ায় অবহেলিত ও ঝরে পড়া নারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল মেরামত, সিএনজিচালক, ইলেকট্রিশিয়ান, কনজিউমারসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হচ্ছে তাদের। এখানে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা। এ পর্যন্ত সহস্রাধিক নারী এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠা ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মা ফাতেমা (রা.) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্সে সরকারিভাবে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান এ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

জানা যায়, বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা দুটি নদীভাঙন এলাকা। যমুনা নদীর গ্রাসে সহস্র মানুষ তাদের ভিটামাটি হারিয়েছেন। অনেকেই সব হারিয়ে ভাসমান জীবনযাপন করছেন। কেউবা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে নদীপারে বসত গড়েছেন, আবার শহরে ‘ঝি’, ভাসমান, ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা পেশায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার নদীভাঙনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে অন্যত্র গিয়ে কেউ স্বাভাবিক আবার কেউবা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছেন। প্রতি বছর এলাকায় কর্মহীনের সংখ্যা বাড়ছে। বেকারত্ব কমাতে সরকারিভাবে ২০০০ সালে বগুড়ার সারিয়াকান্দির যমুনা নদীর পাশে মা ফাতেমা (রা.) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হয়। মহিলা উন্নয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শুরুতে সরকারিভাবে বিনা অর্থে সেলাই, হাতের কাজ, কুটিরশিল্প উৎপাদনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এরপর টেইলারিং, অ্যামব্রয়ডারির কাজ শেখানো হয়। ২০০৬ সালে কেন্দ্রটি রাজস্ব খাতের অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। ২০১৪ সালে গ্রামীণ অবহেলিত নারীদের জন্য শুরু হয় সিএনজিচালিত থ্রিহুইলার ড্রাইভিং এবং মোটরসাইকেল মেকানিক্স প্রশিক্ষণ কোর্স। তখন থেকেই কেন্দ্রটিতে গ্রামীণ দরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্তা এবং বাল্যবিয়ের শিকার নারীদের বিভিন্ন দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা ইউসেফের সহায়তায় বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত রয়েছেন। তিন মাসের কোর্সে মোটরসাইকেল মেকানিক্স, কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেকট্রিশিয়ান ৩টি ট্রেডে বর্তমানে ৫০ জন করে গ্রামীণ অবহেলিত নারী প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। এদের মধ্যে মোটরসাইকেল মেকানিক্সে ১০ জন, কনজিউমার ইলেকট্রনিক্সে ২০ জন এবং ইলেকট্রিশিয়ানে ২০ জন। প্রশিক্ষণার্থীরা এখানে ফ্রিতে থাকা-খাওয়ার সুবিধা পাচ্ছেন। এখানে আবাসিক ভবনে রয়েছে সংযুক্ত বাথরুম এবং ডাইনিং রুম। সেখানে নারীরা অবসর সময়ে টিভি দেখতে পারেন এবং বিশালাকার মাঠে খেলাধুলা করতে পারেন। বর্তমানে ট্রেনিং সেন্টারটির ৫০ জন প্রশিক্ষণার্থীর ১৮ জনই আদিবাসী। তারা রাজশাহী, নওগাঁ এবং দিনাজপুর জেলা থেকে এসেছেন। আদিবাসী নারীরা সাঁওতাল, ওঁরাও এবং পাহান বংশের। তাছাড়া এখানে বেশির ভাগ নারীই স্বামী পরিত্যক্তা। তিন মাসের প্রশিক্ষণ সময়ে থাকা-খাওয়া ফ্রিসহ ৯০০ টাকা প্রশিক্ষণকালীন ভাতা পান তারা। কেন্দ্রটির একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ জনবল কাঠামো রয়েছে ১৩ জনের। ২০১৪ সালের জুন থেকে এ উন্নয়ন কেন্দ্রে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সিএনজিচালিত থ্রিহুইলার চালক ও মোটরসাইকেল সার্ভিস মেকানিক্সের কাজ। পরের বছর থেকে ইলেকট্রিশিয়ান ও কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স ট্রেড কোর্স চালু করা হয়। কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স ট্রেড কোর্সে নারীরা গৃহে ব্যবহৃত লাইট, সৌরবিদ্যুৎ ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের সার্কিট মেরামত করা শিখছেন। একই সঙ্গে নিজস্ব উপায়ে সার্কিট তৈরি করা শিখছেন। মা ফাতেমা (রা.) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারিভাবে ৫০ জনের আবাসিকে থাকা-খাওয়া ও প্রতি মাসে প্রতি প্রশিক্ষণার্থীর জন্য ৩০০ টাকা করে প্রদান করে থাকে। প্রতিটি বিভাগে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব এবং বাছাই করে প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন করা হয়।

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌরসভার মন্টু মন্ডলের মেয়ে মলি পারভীন (২৪)। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে এখন মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। পারিবারিক অভাব অনটনে তিনি ২০২৩ সালে এখানে তিন মাসের ট্রেনিং গ্রহণ করে চাকরি পান। তিনি এখন ঢাকার কালীগঞ্জে কর্মরত। রাজশাহী থেকে এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন রোহিতা সরেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি চাকরির সুখবরও পেয়েছেন। পূর্ণিমা মুর্মু এসেছেন নওগাঁ ধামুইরহাট থেকে। তিনিও প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন এবং চাকরি পেয়েছেন। রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিউটি মেরী মারান্ডিও প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। সদ্য প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করা বগুড়ার সারিয়াকান্দি পৌর এলাকার শিলা আক্তার জানান, ২০১২ সালে তিনি বাল্যবিয়ের শিকার হন। বিয়ের সাত বছর পর বিচ্ছেদ হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। সারিয়াকান্দি উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা লায়লা পারভিন নাহার বলেন, সারা দেশ থেকে আসা গ্রামীণ অবহেলিত নারীরা এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে চাকরি করে আত্মনির্ভরশীল হচ্ছেন। আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে খুব বেশি নারী শিক্ষার্থী নেওয়া যায় না। আসন বৃদ্ধি হলে বেশি নারী প্রশিক্ষিত হবেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *