নারী শিক্ষা নিয়ে নবিজির ভাবনা

নারী শিক্ষা নিয়ে নবিজির ভাবনা

গোলাম রাজ্জাক কাসেমী: মানবতার নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে সর্বপ্রথম নারী জাতির পূর্ণ মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। নারীর শিক্ষা বিস্তারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইতিহাসের কালজয়ী অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) নারীকে যে গুরুত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন, তা ভাস্বর হয়ে থাকবে মহাকাল। তিনি নারীকে যে অধিকার প্রদান করেছেন, তা অতীত ও বর্তমানের কোনো ব্যক্তি, আইন, জীবনপদ্ধতি দান করতে পারেনি।
জ্ঞান অর্জনের বিষয়ে নারী-পুরুষের ব্যাপারে নবিজি (সা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিন্ন। এ প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “প্রত্যেক (নর-নারী) মুসলমানের জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)


উক্ত হাদিসে জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি।মহানবি (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার দুই আয়াতের মাধ্যমে শেষ করেছেন, যা আমাকে আরশের নিচের ভাণ্ডার থেকে প্রদান করা হয়েছে। অতএব এগুলো তোমরা নিজেরা শেখো ও তোমাদের নারীদের শেখাও।’ (দারেমি, হাদিস: ৩৪৩০)
আনসারি নারীরা দ্বিনের গভীর জ্ঞানার্জনে অনেক আগ্রহ রাখতেন, তাই মা আয়েশা (রা.) তাদের প্রশংসা করে বলেন, “আনসারি নারীরা কত ভালো! দ্বিনি জ্ঞানার্জনে লজ্জা তাদের প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে না।” (মুসলিম, হাদিস: ৩৩২)
মূলত ইসলাম শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নর-নারীভেদে ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেনি; বরং এটি সবার জন্যই অবধারিত করা হয়েছে।


হযরত রাসুল (সা.) নারীর মর্যাদা ও শিক্ষা-দীক্ষার উন্নতিকল্পে দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে এমন সব পন্থা ও পদ্ধতি অবলম্বন করতেন, যাতে তা মানুষের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কন্যাদের প্রতি পুত্রদের সমান গুরুত্ব দেওয়ার প্রতি উৎসাহ দিয়ে হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, “কারো যদি একজন কন্যাসন্তান থাকে এবং সে তাকে হত্যা করেনি, কোনো ধরনের অবহেলা করেনি এবং পুত্রসন্তানকে কন্যাসন্তানের ওপর কোনো প্রকার প্রাধান্য দেয়নি। আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৪৬)
মহানবি (সা.) বিভিন্ন সময়ে নারীদের শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়ার জন্য নারীর মাতা-পিতাকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে তিনটি কন্যাসন্তান অথবা তিন বোন প্রতিপালন করল, তাদের শিষ্টাচারিতা শিক্ষা দিল এবং তাদের প্রতি দয়া করল, অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাদের মুখাপেক্ষীহীন করে দিলেন। তাহলে তার জন্য আল্লাহ তায়ালা জান্নাত অবধারিত করে দেবেন।

তখন জনৈক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, দুটি কন্যা প্রতিপালন করলেও? তিনি জবাবে বলেন, দুটি করলেও।’ (মিশকাত, হাদিস : ৪৯৭৫)
অন্য হাদিসে হযরত রাসুল (সা.) নারীদের উত্তম শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “তোমরা নারীদের উত্তম উপদেশ দাও (অর্থাৎ উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করো)।” (বুখারি : ৩৩৩১)

নারী শিক্ষার গুরুত্ব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এক হাদিসে। একবার এক নারী হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, আপনার হাদিস তো শুধু পুরুষরা শুনতে পায়। সুতরাং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করে দিন, যেদিন আমরা আপনার কাছে আসব, আল্লাহ আপনাকে যা কিছু শিখিয়েছেন তা থেকে আপনি আমাদের শেখাবেন।” তিনি বলেন, ‘তোমরা অমুক অমুক দিন অমুক অমুক জায়গায় একত্র হবে।’ সেই মোতাবেক তারা একত্র হয়। নবি করিম (সা.) তাদের কাছে এলেন এবং আল্লাহ তাঁকে যা কিছু শিখিয়েছেন তা থেকে তাদের শিক্ষা দেন। (বুখারি, হাদিস : ৭৩১০)
আশ-শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, একবার আমি হাফসা (রা.)-এর কাছে ছিলাম, তখন নবি (সা.) আমাকে বলেন, “তুমি কি ওকে (হাফসাকে) যেভাবে লেখা শিখিয়েছ, সেভাবে পিঁপড়া (পোকা) কামড়ের ঝাড়ফুঁক শিক্ষা দেবে না?’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৮৭)
হযরত রাসুল (সা.) ক্রীতদাসীকেও শিক্ষাদানের ব্যাপারে মুসলিম সমাজকে উৎসাহিত করেন। অথচ তাদের ব্যাপারে কেউ কোনো দিন চিন্তাও করত না। তিনি বলেন, ‘কারো যদি ক্রীতদাসী থাকে, আর সে তাকে উত্তমরূপে বিদ্যা ও শিষ্টাচার শিখিয়ে স্বাধীন করে দেয়। অতঃপর তাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে, তাহলে তার জন্য দুটি পুরস্কার আছে।’ (বুখারি, হাদিস ৯৭)


এভাবে মহানবি (সা.) মুসলিম নারীদের অন্তরে জ্ঞানার্জনের তীব্র স্পৃহা সৃষ্টি করেছিলেন। এর ফলে হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে ইসলামের প্রথম যুগের নারীরা ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছিলেন। ইবনে সাদ তাঁর ‘তাবাকাতে’ ৭০০ নারীর নাম উল্লেখ করেছেন, যাঁরা রাসুল (সা.) থেকে বা তাঁর সাহাবিদের থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) তাঁর ‘আল-ইসাবাহ ফি তামায়িজিল হাদিস’ নামক গ্রন্থে ১ হাজার ৫৪৩ জন নারী হাদিসবিশারদের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাঁদের পাণ্ডিত্য ও বিশ্বস্ততার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন। উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা (রা.) ছিলেন নারী শিক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বহুসংখ্যক সাহাবি ও তাবেঈন তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেন এবং ইলমে দ্বিন শিক্ষা লাভ করেন।


নবি (সা.)-এর যুগে এবং পরবর্তী যুগগুলোতেও মুসলিম নারীরা চিকিৎসাবিজ্ঞান, কাব্য, সাহিত্য, আইন প্রভৃতি জ্ঞানচর্চায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মহানবি (সা.) সমকালীন অনেক নারী চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধে আহতদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে তারা নবি (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধেও গমন করেছিলেন। নুসাইবা বিনতে কাব আল-আনসারী (রা.) ছিলেন মদীনার একজন প্রখ্যাত নারী চিকিৎসক। উম্মে আম্মারা নামে বেশি খ্যাত এই নারী সাহাবি।


রুফাইদা বিনতে সাদ আল-আসলামিয়া (রা.) ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমকালীন মদীনার অন্য একজন নারী চিকিৎসক। তাঁকে ‘ইসলামের প্রথম নার্স’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি মূলত তাঁর চিকিৎসক পিতা সাদ আল-আসলামির নিকট থেকে চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় এতই ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন যে মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধে আহত সব সৈনিককে তার কাছে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করতেন।


শিফা বিনতে হারেস ইসলামে সর্বপ্রথম পারিবারিক শিক্ষিকা ছিলেন। আর উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান ও উম্মে শারিক ইসলামের প্রসিদ্ধ দাঈ ছিলেন। নারী তাবেঈনদের মধ্যে হাফসা বিনতে সিরিন ইবাদত, ফিকহ ও কোরআন-হাদিসের সুগভীর জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) একজন নারী শিক্ষিকা নাফিসা বিনতুল হাসানের ক্লাসে অংশগ্রহণ করতেন এবং তাঁর থেকে হাদিস শুনতেন। হাফেজ ইবনে আসাকির (রহ.) ৮০ জনের বেশি নারীর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। এ রকম মহীয়সী নারীদের নিয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যা অধ্যয়নে আমাদের উজ্জ্বল অতীত অনুভূত হয়।


মধ্যযুগেও মুসলিম নারীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। সুতাইতা আল-মাহামালি নামের এক নারী গণিতবিদ বাগদাদের এক বিদ্যোৎসাহী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন বাগদাদের একজন বিচারপতি ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব। গণিতের বিভিন্ন শাখায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।


মহানবি (সা.)-এর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে এভাবেই বহু মুসলিম নারী জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় শ্রেষ্ঠত্ব ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
নারী শিক্ষা উন্নয়নে নবি (সা.)-এর ভাবনা ও অগ্রণী ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *