নজরুলের গানে প্রতিফলিত জীবনদর্শন

নজরুলের গানে প্রতিফলিত জীবনদর্শন

ড. জি এম মনিরুজ্জামান
ইংরেজ আগমনের আগে বাংলাদেশের নব্বই ভাগ কবিতাই ছিল গান। বৈষ্ণব পদাবলি বা বৌদ্ধসহজিয়াদের চর্যাই যে সুর সহযোগে গান করা হতো, গান করার উদ্দেশ্যেই লেখা হতো, তা-ই নয়; মনসার পাঁচালি বা কারবালার কথাও সুরযোগে আসরে বা জমায়েতে গান করে পরিবেশন করা হতো।
সেকালের যাবতীয় গীতিকবিতা সুরে বাদ্যযন্ত্রের সংগীতের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট গায়কী রীতিতে গান করা হতো। অর্থাৎ গান দিয়েই বাঙালি তার সব কথা চিরকাল প্রকাশ করে আসছে। এ গান বিচার করেই আমরা গীতিকারদের মনোলোক বুঝতে পারি এবং গান রচয়িতাদের জীবনদর্শন আবিষ্কার করতে পারি। কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করেছেন। সব শাখার মধ্যেই তার জীবনদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু গানের মধ্যে তিনি কীভাবে লুকিয়ে আছেন, সেটা নিশ্চয়ই আলাদা মনোযোগ দাবি করতে পারে।
নজরুলের রাজনৈতিক গান একাধিক ঐতিহাসিক অনুষঙ্গের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা সমকালের রাজনৈতিক র্কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করত, অনুপ্রাণিত করত। এ প্রসঙ্গে দিলীপকুমার রায় স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, কাজী নজরুলের গান শুনে বিচলিত হয়ে পড়তেন বিখ্যাত ব্যক্তিরা। যেমন রামমোহন লাইব্রেরিতে, ওভারটুন হলে, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন নজরুলের শিকল পরার গান শুনে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কাজী নজরুলের আবির্ভাব ও ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে গাওয়া আত্মোৎসর্গের গান :


এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।
অথবা,
ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এ শিকল ঝনঝনা
ওরে মুক্তিপথের অগ্রদূতের চরণবন্দনা
এই লাঞ্ছিতেরই অত্যাচারকে হানছে লাঞ্ছনা
মোদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্রানল।
নজরুল এমন গান গাইতেন যে, ভাঙা গলাকেও ভাঙা মনে হতো না, আগুন ছুটিয়ে দিতেন তিনি। নজরুল জেলে না গেলে কখনোই লিখতে পারতেন না এমন গান। জেলের ভেতরেও নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে বিচলিত করেছিল নজরুলের গান :
কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্তজমাট শিকলপূজার পাষাণবেদী।
নজরুল সম্পর্কে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর গুরুত্বপূর্ণ মত এমন-নজরুল ইসলাম যা রচনা করেছেন, তার সঙ্গে তার বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত অনুভূতির সম্পর্ক রয়েছে। তার ইংরেজ শাসনবিরোধী যেসব রচনা, সেসব আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানকারী কোনো কবির রচনা নয়। তিনি নিজে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, জেল খেটেছেন, জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, দীর্ঘ অনশন পালন করেছেন। সুতরাং এ একেবারে প্রাণের গভীর থেকে প্রত্যক্ষ প্রেরণায় বেরিয়ে আসা বস্তু। এ বৈশিষ্ট্য নজরুলের গান, কবিতা বা অন্যান্য রচনায় লক্ষ করার মতো।


নজরুল জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। এই রাঢ় অঞ্চল শিল্পনগরী ও ব্যবসাকেন্দ্রের জন্য বিখ্যাত ছিল। নানাদিক থেকে আসানসোলের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। রাঢ় অঞ্চল কয়লাখনি, রেলস্টেশন ও অস্ত্র তৈরির কারখানার জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিল। শিল্পপ্রতিষ্ঠার আগে এখানে কৃষিজীবী গ্রামীণ মানুষ বাস করত। খনি ও কারখানার শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে বাস করত নিম্নবর্ণের দরিদ্র, উপজাতি, হিন্দু বাঙালি ও সমাজের বাউরি, বাগদি, হাঁড়ি, মুচি, কুমার, কামার, ছুতোর, লোহার, গোপ, মাহাত, মাহালি, মুণ্ডা, হো, লোধা, খাড়িয়া, সাঁওতাল, ভূমিজসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। কুলি-মজুর-শ্রমিকদের কাজের অবসরে বিনোদনের জন্য চর্চা হতো যাত্রা, থিয়েটার, কবিগান, পালাগান, আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ঝুমুর গান, টুসু গান, ভাদু গান, মেয়েলিগীত, দেহতত্ত্ব গান, লেটোর গান, মনসার গান ইত্যাদি। এসব নিয়ে তৈরি হয় লোকসংস্কৃতি ভিত্তিক সাংস্কৃতিক বলয়। নজরুলের গানে এই হতদরিদ্র উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর জীবনকথা খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কবি। অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের বিরোধী, সাম্যবাদী চিন্তা ও চেতনা, এমনকি নারী জাগরণের কথা নানাভাবে তার গানে প্রকাশ পায়। তিনি প্রথাগত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে গানের বাণী ব্যবহার করেছেন। যেমন :
তাদেরি উষ্ণ শোনিত বহিছে আমাদেরও এই শিরা-মাঝে,
তাদেরি সত্য-জয়-ঢাক আজি মোদেরি কণ্ঠে ঘন বাজে
সম্মান নহে তাহাদের তরে ক্রন্দন-রোল দীর্ঘশ্বাস,
তাহাদেরি পথে চলিয়া মোরাও বরিব ভাই ঐ বন্দি-বাস॥
অথবা,
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া॥
নজরুলের কাছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবশ্রেণির মানুষ সমানভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মানের অধিকারী ছিল। সব ধর্মকে তিনি সমান গুরুত্ব দিতেন। নজরুলের গানে ইসলামি চেতনা যতটা জায়গাজুড়ে আছে, হিন্দু চেতনাও অনুরূপ জায়গাজুড়ে আছে। এর দু-একটি উদাহরণ :
মা গো আমায় শিখাইলি কেন আল্লা নাম
নাম জপিলে আর হুঁশ থাকে না, ভুলি সকল কাম।
অথবা,
তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম!
আমারি মতন দিবস-নিশি
জপিতে শ্যাম-নাম॥
সান্ত্বনা পাই তোমায় ধরে॥
নজরুল ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানের বৈরীভাবে দূর করতে উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মহিমা কীর্তন করেছেন। উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করার সুযোগ নজরুলের থাকায় তিনি নিবিড়ভাবে তা পর্যবেক্ষণ করে তার ভক্তিমূলক গানে তুলে ধরেছেন। উভয় সমাজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকায় জীর্ণপ্রায় সমাজদেহের অভ্যন্তরীণ দোষ-ত্রুটি মুক্ত করতে নজরুলের বেশ ভূমিকা ছিল। তিনি উভয় জাতির ঐতিহ্যগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করে এক অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তার ইসলামি গান শুনলে এবং সেখানে ইসলামি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার ধরন দেখলে তাকে একান্তভাবে মুসলমান মনে হয়। অপরদিকে তার শ্যামাসংগীত, কীর্তন, ভজন শুনলে এবং সেখানে হিন্দু ঐতিহ্য, প্রেম ও সংস্কৃতি তুলে ধরার প্রবণতা লক্ষ করলে তাকে একান্তভাবে বৈষ্ণব মনে হয়। আবার বৈষ্ণব ঐতিহ্যের সঙ্গে ইরানের ঐতিহ্যের সমন্বয় এবং আরবি-ফার্সি শব্দের বহুল ব্যবহার দেখে বিস্ময় জাগে। এ সবকিছুই তার বিশ্বাস ও ধারণা থেকে সমন্বয়সূত্র স্থাপনের এক কৌশল। সমন্বয়বাদী চিন্তাধারার ফলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তিনি ধর্মকে দেখেছেন। এ সমন্বয়ক ধর্ম একান্তই তার নিজস্ব জীবনাদর্শের ধর্ম। এসব কারণে গোলাম মুরশিদ নজরুলের এ সমন্বয়ক ধর্মের নাম দিয়েছেন ‘দ্বীন-এ-নজরুল’।
তার রচিত অসংখ্য রচনা যেমন-‘সাম্যবাদী’, ‘কৃষকের গান’, ‘মানুষ’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘নারী’, ‘কুলি মজুর’, ‘রাজা-প্রজা’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘বাধন হারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘জলপাত্র’ ইত্যাদিতে যেসব মানুষের কথা বলা হয়েছে, তাতে নজরুলের প্রতিফলিত জীবনদর্শনের এক ঐক্যসূত্র পাওয়া যায়। শুধু গানে বা কবিতাতেই সীমাবদ্ধ নয়, নজরুল প্রত্যক্ষভাবে সাম্যবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সাম্যবাদী চেতনাকেই প্রকাশ ও প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। সাম্যবাদ ও মানবতার বিষয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের ভাবনার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি মানুষের প্রতি আস্থা হারাননি, মানুষকে তিনি শ্রদ্ধা করেছেন, ভালোবেসেছেন। তিনি স্রষ্টাকে দেখেননি, কিন্তু মানুষের মধ্যে স্রষ্টাকে পেয়েছেন। মানুষই তার কাছে সত্য। যে মানবতার বন্ধন মানুষকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে সব শান্তিকল্পে উন্নতি প্রগতির ধারায় এগিয়ে নিয়ে একটি সুন্দর পৃথিবী সবার মাঝে উপহার দিতে চায়-নজরুল সেই ধর্মেই বদ্ধপরিকর। সমাজে শুভ ও কল্যাণের জন্য প্রয়োজন শোষণহীন সমাজ। যে কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে বিদ্রোহ ও বিপ্লব ছাড়া স্বাধীনতা ও মুক্তি লাভ সম্ভব নয়-এরকম ধারণা নজরুলের জীবনদর্শনের অন্তর্গত। নজরুল প্রচলিত কুম্ভকর্ণ মার্কা সমাজকে জাগাতে তরুণদের নিয়ে একটি সুষম গণতান্ত্রিক সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। নজরুল-বিশেষজ্ঞ রফিকুল ইসলামের মতে, দ্রোহ-প্রেম-মানবতা কবির রচনাকে চিরন্তন করে সমাজকে নিয়ে গেছে গণমানুষের কাছাকাছি। শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের আর্তি বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার সামাজিক মূল্যবোধে। পাশাপাশি ঘৃণা, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। এজন্য তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন। তিনি তারুণ্যকে, সেবককে বারবার সালাম ও সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করেছেন। গানে কবিতায় সব শক্তি দিয়ে তারই জয় ঘোষণা করেছেন। সামাজিক পরিবর্তনে তিনি তরুণদের সঙ্গে দলপতি নয়, দলভুক্ত হয়ে থাকতে চেয়েছেন। নজরুলের মানবতার গানে দেখা যায় :
ধর্ম-বর্ণ-জাতির ঊর্ধ্বে জাগোরে নবীন প্রাণ!
তোমার অভ্যুদয়ে হোক বিরোধের অবসান।
সংকীর্ণতা ক্ষুদ্রতা ভোলো ভোলো,
সকল মানুষে ঊর্ধ্বে ধরিয়া তোলো!
নজরুল যখন হুগলিতে কঠোর সংগ্রামমুখর সাংসারিক জীবনের মুখোমুখি হয়েছিলেন, এর মধ্যেই স্ত্রী প্রমীলা কবিকে একটি পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছিলেন। পুত্রের নাম রেখেছিলেন ‘কৃষ্ণ মোহাম্মদ’। এভাবে হিন্দু ও মুসলমান নামের সমন্বয়ে তিনি একটি অসাম্প্রদায়িকতার চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বাস্তব জীবনে নিজেকে তিনি সত্যিই কঠিন শিকলের বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছিলেন, যা লাথি মেরে ভেঙে ফেলা যায় না। তাই বাস্তব জীবনের পরাধীনতা বা সামাজিক অবিচারকে স্থায়ীভাবে মেনে নেওয়া অসম্ভব মনে করে তিনি সংগ্রামের বিকল্প বিভিন্ন ধারাকেই গ্রহণ করেছিলেন। নজরুলের গানগুলো এসবেরই প্রতিফলন। নজরুল এভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা জাগাতে চেয়েছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন নতুন এক মানববাদ। এভাবে গানের মধ্যেই ফুটে ওঠে তার জীবনদর্শনের সারাৎসার।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *