দুর্ভিক্ষ নিরাময়ে ইসলামি রাষ্ট্রের চার কর্মসূচি

দুর্ভিক্ষ নিরাময়ে ইসলামি রাষ্ট্রের চার কর্মসূচি

মো. আবদুল মজিদ মোল্লা: করোনা মহামারির প্রভাব, বৈশ্বিক মন্দা ও সংঘাতের কারণে আগামী দিনগুলোকে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বহু দেশ চরম আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামীতে তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। সেসময় তীব্র খাদ্যসংকট তৈরি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে একজন মুমিনের করণীয় সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদিসে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা আছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) দুর্ভিক্ষের বছর বলেন, আর সেই বছরটি ছিল ভীষণ দুর্বিপাক ও কষ্টের বছর। ওমর (রা.) পল্লী অঞ্চলের বেদুইনদের উট, খাদ্যশস্য ও তৈল প্রভৃতি সাহায্যসামগ্রী পৌঁছাবার চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি গ্রামাঞ্চলের এক খণ্ড জমিও অনাবাদি পড়ে থাকতে দেননি এবং তার চেষ্টা ফলপ্রসূ হলো। ওমর (রা.) দোয়া করতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি তাদের জীবিকা পর্বত চূড়ায় পৌঁছে দিন’। আল্লাহ তাঁর ও মুসলিমদের দোয়া কবুল করলেন। তখন বৃষ্টি বর্ষিত হলে তিনি বলেন, সব প্রশংসা আল্লাহর! আল্লাহর শপথ! যদি আল্লাহ এই বিপর্যয় দূর না করতেন, তবে আমি কোনো সচ্ছল মুসলমান পরিবারকেই তাদের সঙ্গে সমসংখ্যক অভাবী লোককে যোগ না করে ছাড়তাম না। যতটুকু খাদ্যে একজন জীবন ধারণ করতে পারে, তার সাহায্যে দুজন লোক ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতে পারে। (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৫৬৪)

দুর্ভিক্ষ নিরাময়ের চার কর্মসূচি
উল্লিখিত হাদিসে দুর্ভিক্ষ নিরাময়ের গুরুত্ব চারটি কাজের নির্দেশনা পাওয়া যায়। যার মধ্যে কিছু সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আর কিছু সামগ্রিকভাবে সবার দায়িত্ব।

১. অবহেলিত অঞ্চলের প্রতি মনোযোগ: হযরত ওমর (রা.) প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার পৌঁছে দিয়েছিলেন। সুতরাং দুর্ভিক্ষের সময় দেশের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তাদের কাছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিতে হবে। তবে সমাজ ও রাষ্ট্র যদি এই দায়িত্ব অবহেলা করে, তবে তাদের প্রতি কুরআনের হুঁশিয়ারি হলো, ‘আপনি কি তাকে (তার পরিণতি) দেখেছেন? যে দ্বিন অস্বীকার করে। সে তো এতিমদের রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং সে অভাবগ্রস্তদের খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না।’ (সূরা মাউন: আয়াত ১-৩)

২. সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার: হযরত ওমর (রা.) দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার। বিশেষত আল্লাহ প্রদত্ত কৃষি ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন তিনি। চাষযোগ্য একখণ্ড ভূমিও তিনি অনাবাদি ফেলে রাখেননি। শুধু দুর্ভিক্ষ নয়; বরং সব সময়ই ইসলাম চাষযোগ্য জমি চাষ করতে উৎসাহিত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কেউ যদি অনাবাদি ভূমি আবাদ করে, তবে সে তার মালিক। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৩০৭৩)
উল্লিখিত হাদিসের আলোকে ফকিহ আলেমরা বলেন, মানুষের ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়-এমন অনাবাদি ভূমি যদি কেউ আবাদ করে, তবে সে তার মালিকানা লাভ করবে। তবে শর্ত হলো, এমন ভূমি গ্রহণের পর তা অনাবাদি অবস্থায় তিন বছরের বেশি সময় ফেলে রাখতে পারবে না। (ইসলামি অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ণ, পৃষ্ঠা ১৮০)

৩. আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা: দুর্ভিক্ষ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ। তাই কোনো সমাজে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে প্রথম কাজ হলো নিজেদের ভুল-ত্রুটি ও পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাঁর সাহায্য চাওয়া। ওমর (রা.) যেমনটি করেছিলেন। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত, যেখানে আসত সবদিক থেকে তার প্রচুর জীবনোপকরণ। অতঃপর তা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করল, ফলে তারা যা করত তার শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তাদের আস্বাদন করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদনের।’ (সূরা নাহল: আয়াত ১১২)

৪. খাদ্যের সুষম বণ্টন: হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) দুর্দিনে সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের দায়িত্ব গ্রহণের কথা বলেছেন। যেন সমাজের এক শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; বরং বিদ্যমান খাবারের মাধ্যমে সবাই মিলেমিশে টিকে থাকতে পারে। পবিত্র কুরআনে খাদ্য বণ্টনে উৎসাহিত করে এরশাদ হয়েছে, ‘খাবারের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে এবং বলে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবার দান করি। আমরা তোমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়।’ (সূরা দাহর: আয়াত ৮-৯)

আল্লাহ দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা থেকে আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন। আমিন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *