জলবায়ু সহনশীল বাণিজ্যিক কৃষি

জলবায়ু সহনশীল বাণিজ্যিক কৃষি

ড. মো. জামাল উদ্দিন
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই জলবায়ু সহনশীল ফসলের গবেষণায় একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে। আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে সারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের লক্ষ্যে হিমাগার নির্মাণের জন্য আমাদের বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমি জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক ‘খাদ্য ব্যাংক’ চালুর প্রস্তাব করছি। ‘ভাষণে খাদ্যপণ্য রপ্তানি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর টেকসই সমাধান নিশ্চিত’ করার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়েছেন।


ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট এগ্রিকালচার বা জলবায়ু সহনশীল কৃষি একটি বেশ আলোচিত বিষয়। জলবায়ু সহনশীল কৃষি বলতে অভিযোজন, ব্যবস্থাপনা কৌশল, সর্বস্তরে উপযোগী জীববৈচিত্র্য আনয়ন ইত্যাদি বোঝায়, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে টেকসই কৃষির উন্নয়নকে নিশ্চিত করে। জলবায়ু সহনশীল কৃষি পাঁচটি স্তম্ভ নিয়ে গঠিত যেমন-থ্রেশহোল্ড ক্ষমতা, মোকাবিলা করার ক্ষমতা, পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা, অভিযোজিত ক্ষমতা ও রূপান্তর ক্ষমতা। জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনের লক্ষ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও দুর্বলতা হ্রাস করা, স্থিতিস্থাপকতা শক্তিশালী করা, প্রত্যাশা করার ক্ষমতা বাড়ানো এবং পরিবর্তনে সফলভাবে সাড়া দেওয়া। জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার উন্নতির সঙ্গে জলবায়ু ঝুঁকিগুলো আরো ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করাও অভিযোজনের অন্যতম লক্ষ্য।


জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ সম্ভাব্য প্রভাবগুলো এড়াতে কাজ করলেও আমাদের অবশ্যই সেই প্রভাবগুলোর প্রতি আরো স্থিতিস্থাপক হতে হবে, যা এখন অনিবার্য। এই প্রভাবগুলো প্রায়শই কম আয়ের সম্প্রদায়কে অসমভাবে প্রভাবিত করে, যা ন্যায়সংগত এবং সক্রিয় স্থিতিস্থাপকতা, পরিকল্পনা ও সম্পদ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তাকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে বার্তা দেয়। অবকাঠামো আপডেট করতে এবং জনগোষ্ঠীকে চরম আবহাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর অন্যান্য প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হতে থাকবে। তাই ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকি কমাতে পরিবর্তনের পূর্বাভাস সঠিকভাবে দেওয়া খুব জরুরি। তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী ঘটনাগুলোর প্রভাবসমূহ প্রশমিত করার জন্য অবকাঠামো আপডেট এবং জলবায়ু-স্মার্ট পরিকল্পনায় বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। জলবায়ু সহনশীল বাণিজ্যিক কৃষি পরিকল্পনার অনেক অনুপ্রেরণামূলক ঘটনা রয়েছে, যা ভবিষ্যতের উদ্যোগের জন্য মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান (ঘধঃঁৎব-নধংবফ ংড়ষঁঃরড়হং) তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।


বাংলাদেশ তার অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান, প্লাবনভূমির আধিপত্য, নি¤œ উচ্চতা, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব, উচ্চমাত্রার দারিদ্র্য এবং প্রকৃতি, এর সম্পদ ও পরিষেবার ওপর অত্যধিক নির্ভরতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা ও ঘূর্ণিঝড় কৃষি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ফলে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উচ্চঝুঁকি তৈরি করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি-বাস্তুসংস্থানিক অঞ্চলে (অঊতং) বড় আকারের জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক অনুশীলন (কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত) বাস্তবায়িত হচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্বলতা ও ঝুঁকি হ্রাস করার এবং টেকসই কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কৃষি অভিযোজন বিকল্পগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করা এবং চিহ্নিত করা জরুরি। বাংলাদেশের কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো মূল্যায়নপূর্বক বিভিন্ন এইজেড-(অঊত)-ভিত্তিক বিকল্প অভিযোজনব্যবস্থার মধ্যে কৃষকের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।


জাতীয় দৈনিকে প্রচারিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক, এমপি বলেছেন, ‘এখন সরকারের মূল লক্ষ্য হলো কৃষিকে বাণিজ্যিক ও আধুনিক করা। কৃষির রূপান্তরে সরকার কাজ করছে। যান্ত্রিকীকরণে বিশাল ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এগ্রো প্রসেসিং, ফসলের উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল কৃষিতে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনা, খরা, লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন প্রতিকূল এলাকায় ফসলের চাষ, শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি, বেশি উৎপাদনশীল জাতের উদ্ভাবন ও চাষ, ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল কৃষির জন্য কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিবান্ধব উদ্যোগের ফলে গত ১৩ বছরে দেশের কৃষিতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জিত হয়েছে।’


প্রতিকূল পরিবেশে উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের শারীরবৃত্তীয় ও জৈব-রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেয়। এই খাপ খাইয়ে নেওয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলে। ফসলের অভিযোজন কৌশলের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কৃষিবিজ্ঞানীরা প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য বিভিন্ন ধরনের ফসলের জাত উদ্ভাবন করে চলেছেন। খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা বা বন্যা ইত্যাদি প্রতিকূল বা বিরূপ পরিবেশে ফসলের অভিযোজন কৌশল সম্পর্কে মাঠকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ জরুরি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)-সহ ব্রি, বিনা ও নার্সভুক্ত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান জলবায়ু সহনশীল বিভিন্ন ফসলের জাত ও অভিযোজন কৌশল উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। বারির সম্মানিত মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার সম্প্রতি পার্টনার প্রকল্পে (বারি অঙ্গ) জলবায়ু সহনশীল এলাকা উপযোগী বারি উদ্ভাবিত জনপ্রিয় ফসলের উচ্চফলনশীল জাতের পাইলট প্রোডাকশন ও উদ্যোক্তা সৃজনের মাধ্যমে গ্রামীণ রূপান্তর, পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এভাবে জলবায়ু সহনশীল বাণিজ্যিক কৃষি রূপান্তরে সহায়ক হচ্ছে।


জলবায়ু সহনশীল বাণিজ্যিক কৃষির জন্য জলবায়ু তথ্য বৃদ্ধি, নমনীয় ও গতিশীল সিস্টেমের জন্য অর্থায়ন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়ানো দরকার। এটিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক, পরিবেশগত স্থিতিস্থাপকতা এবং নির্দিষ্ট মূল্যবোধের বৃহত্তর বিবেচনার সঙ্গে একীভূত হওয়া দরকার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্বলদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সম্পৃক্ততা থাকলে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজতর হয়। কৃষিসংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ফসলের লবণাক্ত ও খরাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। স্বল্প বা মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততা ও খরাপ্রবণ এলাকায় আধুনিক পদ্ধতিতে এই জাতগুলো চাষাবাদ করে কৃষিকে টেকসই রূপ দেওয়া সম্ভব। আকস্মিক প্লাবন, জলাবদ্ধতা ও জোয়ার-ভাটাসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ফসলের জাত ব্যবহার আরো বাড়ানো দরকার। তবে শুধু জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজন এলাকা উপযোগী অভিযোজন কৌশলসমূহ নিয়ে কৃষকদের দক্ষ করে তোলা। স্থানীয় কৌশলসমূহ চিহ্নিত করে তা লাগসই করানো গেলে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হবে।


জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের সব অঞ্চলে ক্ষতির ধরন ও মাত্রা একই রকম হয় না। ফসলের কোনো একটি জাত বা প্রযুক্তি সব এলাকার জন্য কার্যকর না-ও হতে পারে। অভিযোজন কৌশলেও ভিন্নতা থাকতে পারে। উপযোগী চাষাবাদ পদ্ধতি, ফসল ধারার পরিবর্তন, পানি ব্যবস্থাপনা ও প্রতিকূল পরিবেশ/আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেরও ভিন্নতর ব্যবস্থা রয়েছে। অভিযোজন কৌশলে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিতে পারলে জলবায়ু সহনশীল কৃষি ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী কৃষির জন্য কৃষকদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপযোগী অভিযোজন কৌশল, শস্য বহুমুখীকরণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (শস্যবিমা) বিশেষভাবে দরকার। সংশ্লিষ্ট কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত বেশ কয়েকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাধিক এনজিও পরিবর্তিত জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষিব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে গবেষণা ও কর্মকাণ্ড জোরদার করেছে। সেই সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় নীতি-সহায়তাও দিয়ে যাচ্ছে অবিরতভাবে। শস্যবৈচিত্র্য কৃষকদের জলবায়ু সহনশীলতা এবং আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি এড়াতে কৃষিতে সহনশীলতা আনার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি কার্যকর উপায় হচ্ছে এই শস্যবৈচিত্র্য বা শস্য বহুমুখীকরণ। সেই সঙ্গে অভিযোজন কৌশলসমূহ যথাযথভাবে কৃষক পর্যায়ে দক্ষতার সঙ্গে রপ্ত করানো গেলে জলবায়ু সহনশীল বাণিজ্যিক কৃষি রূপান্তর সহজ হবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *