কোরবানির হাকিকত

কোরবানির হাকিকত

ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান

কোরবানি মুসলমানদের জন্য একটি ওয়াজিব ইবাদত। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ অনুষ্ঠিত হয়। একে বকরি ঈদ-ও বলা হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বকরিদ’ কবিতায় বলেন-
‘শহিদানদের ঈদ এলো বকরিদ
অন্তরে চির নৌ-জোয়ান যে তারি তরে এই ঈদ
আল্লাহ্র রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান
নির্লোভ নিরহংকার যারা যাহারা নিরভিমান
দানব দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে
ফিরদাউস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে
অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাস করিতে যারা
জন্ম লয়েছে চির-নির্ভীক, যৌবন মাতোয়ারা
তাহাদেরি শুধু আছে অধিকার ঈদগাহে ময়দানে
তাহারাই শুধু বকরিদ করে জান-মাল কোরবানে।”
[বকরিদ/কাব্যগ্রন্থ জাগরণ]
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “আপনি আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।” (সূরা কাওছার ১০৮: আয়াত ২) তিনি আরো বলেন, “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি বিধিবদ্ধ করে দিয়েছি যাতে তারা আল্লাহ্ তাদেরকে যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন তা জবেহ করার সময় তার উপর আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করে।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৩৪)
কোরবানি শব্দটি আরবি ‘ক্বুরবুন’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা, উৎসর্গ করা, সান্নিধ্য লাভ করা ইত্যাদি। যেহেতু মুসলমান ব্যক্তি তার প্রিয় বস্তু আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করে প্রমাণ করে, সে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহ্কে বেশি ভালোবাসে এবং এরই মাধ্যমে সে আল্লাহ্র নিকটবর্তী হয়, এজন্য এ ইবাদতকে কোরবানি বলে। ইসলামি পরিভাষায় কোরবানি হলো, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ই জিলহজ তারিখসমূহে সকাল থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত হালাল পশু জবাই করাকে বুঝায়।

কোরবানি সুন্নতে ইব্রাহিম। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয়ই আমার নামাজ ও আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও আমার মরণ একমাত্র আল্লাহ্রই জন্য, যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক।” (সূরা আনআম ৬: আয়াত ১৬২)
হযরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি ইতিহাসে প্রথম। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “তুমি তাদের যথাযথভাবে শুনাও আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত। যখন তারা কোরবানি করেছিল তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কবুল করা হয়নি। সে বলল: “অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব।’ অপরজন বলল: ‘আল্লাহ্ কেবলমাত্র মোত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।” (সূরা মায়েদা ৫: আয়াত ২৭)
মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সময় থেকে কোরবানির বর্তমান প্রথা চালু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হযরত ইব্রাহিম (আ.) বললেন- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সুপুত্র দান করুন। অতঃপর আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। তারপর সে যখন তাঁর পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি; এখন তুমি বলো, তোমার মতামত কী? পুত্র বলল, হে আমার আব্বাজান! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, সেটি পূর্ণ করুন। ইনশাআল্লাহ্, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর যখন তাঁরা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন, তখন আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! আপনি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালেন। আমি এরূপেই খাঁটি বান্দাদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (সূরা আস সাফফাত ৩৭: আয়াত ১০০ থেকে ১০৫) এমনিভাবে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমি দু’জবেহকৃত পিতার সন্তান। একজন হযরত ইসমাঈল (আ.) এবং অপরজন হলেন- হযরত আবদুল্লাহ (আ.)।” (তাফসীরে কাবীর ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬০৮)
পবিত্র কুরআন ও হাদিসের এ অকাট্য বাণী মোবারকই মুসলিম বিশ্বের চিরায়ত ধর্মবিশ্বাস, মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল জবিহুল্লাহ (আ.)-কে আল্লাহ্র নির্দেশে কোরবানি করেন। অতঃপর মহিমান্বিত আল্লাহ্ পিতা-পুত্রের কোরবানি কবুল করেন এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা জবেহ করে দেন। পবিত্র মক্কা নগরীর মিনা প্রান্তরে সংঘটিত কোরবানির এ আদর্শ অনুসরণে হজের অনুষ্ঠানে আগত লক্ষ লক্ষ হাজিদেরকে প্রতি বছর মিনা প্রান্তরেই কোরবানি করতে হয়। হজের অনুষ্ঠানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বিশ্বজুড়ে কেবল উম্মতে মোহাম্মদী তথা মুসলমানদেরকে পশু কোরবানির এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালন করতে হয়।

আল্লাহ্র রাসুল (সা.) যখন কোরবানি করতেন, তখন তিনি বলতেন [ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিইয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বা হানীফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীনা” “ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন, লা শারীকা লাহূ, ওয়া বিযালিকা উমিরতু ওয়া আনা আওয়্যালুল মুসলিমীন” আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়ালাকা ‘আন মুহাম্মাদিও ওয়া উম্মাতিহী বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবারু ছুম্মা যাবাহা।] অর্থাৎ- নিশ্চয়ই আমি আমার চেহারাকে সেই সত্তার চেহারা মোবারকের দিকে ফিরালাম, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই। নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ্রই জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই, আর আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই মুসলিমদের মধ্যে প্রথম। হে আল্লাহ্! (এই পশু) তোমার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এবং তোমারই উদ্দেশে উৎসর্গিত। মোহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে এবং তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে। আল্লাহ্ তোমার নামে কোরবানি করছি এবং আল্লাহ্ মহান। অতঃপর রাসুল (সা.) জবেহ করতেন। (আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১২৮)
কোরবানির হাকিকত
কোরবানি হচ্ছে নিজের প্রিয়বস্তু আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করা। নিজের জীবাত্মার পশুপ্রবৃত্তিকে আল্লাহ্র রাস্তায় কোরবানি করা, অর্থাৎ নিজের স্বেচ্ছাচারিতাকে পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র ইচ্ছার উপর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য হাসিল করাই হাকিকতে কোরবানি।
প্রকৃত অর্থে কোরবানি হচ্ছে- মানুষের আত্মা থেকে পশু প্রবৃত্তিকে দূর করে আল্লাহ্র প্রেম হাসিল করা। অর্থাৎ জীবাত্মার কুরিপুসমূহ, যথা- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে পরিশুদ্ধ করা। অন্তরে আল্লাহ্র প্রেম প্রবল হয়ে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলে পশু প্রবৃত্তি আপনা-আপনিই দূর হয়ে যায়। তবে কোরবানির বাহ্যিক অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কুরিপুকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মানসিকতা তৈরি করার একটা প্রশিক্ষণ।

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) ব্যক্তিস্বার্থকে কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছিলেন। আল্লাহ্র সঙ্গে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য আল্লাহ্ কোরবানি চান আর এ কোরবানির অর্থ শুধুমাত্র পশু জবেহ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এই কোরবানি নিজ অন্তরে লুকায়িত পশুত্বের কোরবানিকেই বুঝায়। আমরা যদি মনের পশুকে কোরবানি করতে পারি, তাহলেই আমরা আল্লাহ্ তায়ালার প্রিয়দের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারব। এছাড়া বাহ্যিকভাবে যত বড়ো পশুই জবাহ করি না কেন, তা মহান আল্লাহ্র কাছে মূল্য রাখে না। আল্লাহ্ তায়ালা মানুষের হৃদয় দেখে থাকেন। কে কোন নিয়তে কোরবানি করছে এটাই আল্লাহ্ দেখেন।
হাকিকত কোরবানি করা প্রসঙ্গে মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন- “পশু কোরবানির আনুষ্ঠানিকতার অন্তরালে নিজের ভিতরের পশুকে কোরবানি করাই হাকিকতে কোরবানি। কোরবানি নিজের হাতে করা উত্তম। কোরবানি কোনো বান্দার নামে নয়, বরং বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহ্র নামে কোরবানি করতে হয়।” এই প্রসঙ্গে মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর বলেন, “মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী একজন আশেকে রাসুল হিসেবে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করে এসে নিজের কোরবানি নিজের হাতে করার চেষ্টা করবেন। সেই সাথে মনে মনে আজিজি করে বলবেনÑ হে আল্লাহ্! এ পশু কোরবানি কবুল করে এর বিনিময়ে তুমি আমার নফ্স তথা আমার জীবাত্মার পশুপ্রবৃত্তিকে কোরবানি করে দিয়ে আমাকে তোমার প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী বানাও।”
প্রতি বছর সারাবিশ্বে কোটি কোটি পশু আল্লাহ্র নির্দেশের ওপর আমল করে মুসলিম উম্মাহ কোরবানি দিয়ে থাকে। এই যে পশু কোরবানি করা হয়, এগুলো তো আল্লাহ্র কাছে পৌঁছে না। আল্লাহ্ তায়ালা কোরবানিকারীর অন্তর দেখে থাকেন। কোরবানিকারী লোক দেখানোর জন্য কোরবানি দিলো, না আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য দিলো, এটাই মূল বিষয়। আর এটাই মহান প্রভু দেখে থাকেন। কেউ যদি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করে থাকে, তাহলে আল্লাহ্ তায়ালা তার এ কোরবানি গ্রহণ করবেন, অন্যথায় তার কোরবানির কোনো মূল্য আল্লাহ্র কাছে নেই। যেভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- “আর আল্লাহ্র কাছে পৌঁছে না এগুলোর মাংস এবং না এগুলোর রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৩৭) অর্থাৎ আমাদের অন্তরে আল্লাহ্র প্রতি কতটুকু কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা রয়েছে, সেটিই পৌঁছায়। তাই আমাদের কোরবানি করতে হবে কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। কোরবানির পেছনে কোনো ধরনের লোক দেখানো উদ্দেশ্য যেন না থাকে। তবেই আমাদের ঈদুল-আজহা বা বকরি ঈদ সার্থক হবে।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, পশু যদি জবাই করতেই হয় তবে মনের পশুকে আগে জবাই করো। তারপর প্রতীকি পশু জবাই করো আর গোশত খাও তাতে আপত্তি নাই।
‘মনের পশুরে কর জবাই
পশুরাও বাঁচে বাঁচে সবাই।’
একই ভাবাদর্শে আরেক কবি লিখেছেন-
‘আত্মত্যগের ঈদ হলো ভাই
ঈদুল আজহা কোরবানির ঈদ
আত্মত্যাগের আদর্শে আজ
জাগিয়ে দাও ভাঙ্গিয়ে নিদ
শুধু পশু কোরবানি নয়
তারই সাথে করবো জবাই
মনের ভেতর পুষে রাখা
পশুটাকে আজকে সবাই।’
তথ্যসূত্র:
১। মুক্তি কোন পথে? সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.), পৃষ্ঠা ১৫২
২। সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.), ১ম খণ্ড, তৃতীয় পুনঃমুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০০৮, পৃষ্ঠা ৫৯
৩। মোহাম্মদী ইসলামের তালিম, ইমাম প্রফেসর ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.), পৃষ্ঠা ১৮০
৪। নজরুলের কবিতায় কোরবানি ও ঈদুল আজহা, আমিন আল আসাদ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত নিউজ লেটার জুলাই-আগস্ট ২০১৮
৫। কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ ‘জাগরণ’ থেকে ‘বকরিদ’ কবিতা

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *