কৃষিতে নীরবে ঘটছে নবজাগরণ

কৃষিতে নীরবে ঘটছে নবজাগরণ

এ এইচ এম ফিরোজ আলী: সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই এই দুনিয়ায় কৃষির একক অবদান। কৃষিভিত্তিক সমাজের সূচনা হয় ১০ হাজার বছর আগে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষি এ দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, জাতীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কৃষির উন্নতি দারিদ্র্য বিমোচনে বড় হাতিয়ার। কৃষিতে মাটি ও পানি অমূল্য সম্পদ। বলা হয়, মাটি ও পানি জীবনের উৎস। দেশের ৪১ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান এবং জাতীয় আয়ের সাড়ে ২২ শতাংশ জোগান দেয় কৃষি। বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্য ও পুষ্টি, মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয় কৃষি। কৃষি অর্থনীতির মূল উপখাত ফসল, প্রাণিসম্পদ, বন, পাট ও তাঁতশিল্প। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কুটিরশিল্পে সবচেয়ে সম্পদশালী ছিল এই বাংলা। উর্বরা মাটির এই ভূখণ্ডে মোগল, ইংরেজ ও পাকিস্তানের অর্থ-সম্পদের প্রধান উৎস ছিল এই দেশ। তবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে অন্য দেশে। অপুষ্টি, দারিদ্র্য, মঙ্গাপীড়িত বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে কৃষি উন্নয়নে বিশ্বে এখন রোল মডেল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা তৎকালীন ২১ হাজার ২০৮.৩৬ কোটি টাকার সম্পদ, ৩০ লাখ টন খাদ্য নষ্ট এবং ৪৩ লাখ ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই করেছিল। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদে প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ২৫ বিঘা পর্যন্ত জামির খাজনা মওকুফ, গরিব কৃষকদের মধ্যে খাসজমি বিতরণ, পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার কৃষকদের বিরুদ্ধে ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করেন। কৃষকদের সহজ শর্তে কৃষিঋণ, ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা, বিএডিসির মাধ্যমে কৃষিতে সার, বীজ, চাষাবাদের গরু, সেচ ব্যবস্থাপনায় ভর্তুকির এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বিশ্বব্যাংকের জরিপে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়। তখন প্রায় ৩ লাখ ৪ হাজার টন গম, বোরো, আলুবীজ, ২০ হাজার পাওয়ার পাম্প, ১ লাখ হালের বলদ, ৫০ হাজার দুগ্ধগাভি বিতরণ করেন। তিনি ২৩ মাসে ১০ কোটি টাকার তাকাবী ঋণ, ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ, ৩০ কোটি টাকার রিলিফ বণ্টন করেছিলেন। কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৫০০ কোটি টাকার বাজেটে ১০১ কোটি টাকা কৃষিতে বরাদ্দ দিয়েছিলেন। এই ভূখণ্ডের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এক সোনালি অধ্যায়ের নাম কৃষি। দক্ষিণ এশিয়ার নিচু ভূমি, ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডে মোট জমির পরিমাণ ১৪.৪ মিলিয়ন হেক্টর, এর মধ্যে ৬৬.৬ শতাংশ ভূমি কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয়, বাকি ২০.১ শতাংশ ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা, স্থায়ী জলধারা ইত্যাদি। বিবিএস ২০২২ সালের জরিপে আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ ৮৮.২৯ হেক্টর এবং এই জমিতে ৯০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন করে ৮০ শতাংশ খাদ্যের জোগান দেয় কৃষি।
এ দেশে প্রতি বছর মানুষ বাড়ছে, খেতের জমি কমছে। কৃষক দোআঁশ, বেলে, এটেল মাটিতে জৈব, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদন করছেন। শিলাপাথর ও লাল মাটির পাহাড়ে চা, আনারস, কাঁঠাল, আম, লিচু, পেয়ারাসহ অনেক রকম ফসল উৎপাদন করছেন। নৃগোষ্ঠীরা পাহাড়ে জুম, আদা, হলুদ, লেবুসহ অনেক ফসল উৎপাদন করে জীবন রক্ষা করছেন। কৃষিবিজ্ঞানীরা বিনা জাতের ধান ২৪টি, তেল ফসল ৩০টি, ডাল ৩৩টি, গম ১টি, পাট ২টি, সবজি ১৪টি, মসলার জাত ৫টি, লেবু ২টি জাত উদ্ভাবন করে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। বিনা ১৬ ও ১৭ জাতের ধান এবং হরিপদ কাপালির হরি ধানের ফসল হয় বেশি। প্রখ্যাত কৃষিবিদ শায়েখ সিরাজের উপস্থাপনায় ‘হূদয়ে মাটি মানুষ’ এবং বিটিভির মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানসহ দেশের ৫০ শতাংশ চ্যানেল কৃষির অনুষ্ঠান প্রচারের কারণে কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর গণভবনের ‘কৃষি খামার’ কৃষক সমাজের আইকন বলে মনে করা হচ্ছে। দেশে এখন ৭২ জাতের ফসল উৎপাদন হয়।
দেশে প্রতি বছর ৪ লাখ ৮৫ হাজার টন করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে। খাদ্য উৎপাদনে চীন ও ভারতের পর বাংলাদেশ তৃতীয়। চলতি বছর ৫ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৯৮ সালের দীর্ঘ বন্যার পর খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন করে ৪০ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকায় জাতিসংঘ শেখ হাসিনাকে ‘সেরেস’ পদকে ভূষিত করে এবং বিশ্বে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০১০ সালে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করায় বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা অনেক গুণ বেড়েছে এবং প্রতি বছর পাট উৎপাদন হয় ৮০-৯০ লাখ বেল। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাট খাতে আয় হয় ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার।
১৯৭২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ, বর্তমানে ১০ শতাংশ। দেশে অর্ধেক কৃষক ভূমিহীন। কৃষকের জমি এখন ধনীদের হাতে। প্রকৃত কৃষকেরা এখন বর্গাচাষি। একসময় কৃষিতে উৎপাদন খরচ ছিল খুবই কম, যান্ত্রিক কারণে উৎপাদন খরচ এখন বেশি।
২০১৬-১৭ সালে কৃষিতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, ২০২১-২২ সালে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ১৫৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিগত ১৩ বছরে ৯৭ হাজার ৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সারে ভর্তুকি ৯৫ হাজার ১৬ কোটি ৫ লাখ, বিদ্যুতে ১ হাজার ৯৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সার ও কীটনাশকের দাম কমিয়ে টিএসপি ৮০ থেকে ২৭ টাকা, ডিএপি ৯০ থেকে ২১ টাকা, এমওপি ৭০ থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রতি কেজি ইউরিয়ায় ৮২ টাকা, টিএসপিতে ৫০ টাকা, ডিএপিতে ৭৯ টাকা, এমওপিতে ৪১ টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার। কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ৫০-৭০ শতাংশ ও বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়। বরেন্দ্র এলাকায় কৃষিতে সেচকাজে ১০০ ঘণ্টা বিদ্যুত বিল মওফুক করা হয়েছে।
সরকারের কৃষি অনুকূলনীতির কারণে কৃষকদের ঘামঝরা পরিশ্রমে কৃষির উন্নতি হলেও তাদের রক্ত জোঁকের মতো চুষে খাওয়া হচ্ছে এবং প্রকৃত কৃষকদের সরকারের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে হয়রানি করা হচ্ছে। অকৃষক, ব্যবসায়ী ও ধনীরা সার, বীজ, চারাসহ ভর্তুকি পাচ্ছেন। অনেকেই এসব থানা সদরে বিক্রি করে দেন। ছেঁড়া লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা কালো দেহের হালকা চিকন লোক কৃষিঋণ আনতে গেলে ব্যাংক কর্মকর্তার পছন্দ হয় না। অনেক সময় ঘুষ দিয়ে ঋণ আনতে হয়। দেশের অধিকাংশ ভূমি অফিস দুর্নীতির বড় আখড়া। উন্নত রাষ্ট্র বা স্মার্ট রাষ্ট্র গঠনে কৃষির অনিয়ম দুর্নীতি, কৃষক হয়রানি বন্ধ করে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। (১) প্রতি উপজেলায় প্রকৃত কৃষকের নাম তালিকা করে যথানিয়মে সব ভর্তুকি বিতরণ, (২) খাসজমি প্রভাবশালীদের হাত থেকে উদ্ধার করে গরিব কৃষকদের মধ্যে বণ্টন, (৩) ইউনিয়ন-উপজেলা ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে অত্যাধুনিক বীজাগার নির্মাণ এবং দেশের প্রতিটি পুরাতন বীজাগার সংস্কার করে বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ, (৫) সার-কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ।
প্রযুক্তি নামক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় কৃষিতে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আজ শুধু একলা চাষি কাজ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে বৈজ্ঞানিকের যোগ দিতে হইবে’ সে কথাই এ দেশের মানুষকে যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করছে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *