কারার ঐ লৌহকপাট

কারার ঐ লৌহকপাট

শিল্পীর স্বাধীনতা
রাজিক হাসান
‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি লেখা হয় ১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জেলযাত্রার পর। দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তীদেবী তখন ‘বাঙ্গলার কথা’ সাপ্তাহিক পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছেন। বাসন্তীদেবীর অনুরোধে সাড়া দিয়েই নজরুল গানটির কাব্যরূপ তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকার ‘২০ জানুয়ারি ১৯২২’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই গান।
গানটির সুরারোপ করেন কাজী নজরুল ইসলাম স্বয়ং। এক্ষেত্রে তিনি বেছে নেন সামরিক মার্চ বা প্যারেডের সুর। ইংরেজ কর্তৃক ‘ভাঙার গান’ বাজেয়াপ্ত হলে ২৫ বছর গানটির দালিলিক অস্তিত্ব হারিয়ে যায়। কিন্তু গানটি ঘুরেছে জেল থেকে জেলে।
১৯২৯ সালে অ্যালবার্ট হলে নজরুলকে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঘোষণা করেন, নজরুলের গান গাওয়া হবে যুদ্ধক্ষেত্রে, কারাগারে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ‘ভাঙার গান’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। পরে গানটি রেকর্ড করেন গিরীন চক্রবর্তী। তারপর ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ সিনেমাতে গানটি ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও এই গান জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কারারুদ্ধ রাজনৈতিক বন্দীরা গেয়ে ওঠেন ‘কারার ঐ লৌহকপাট’। আজও এই গান মুক্তিকামী বাঙালির সংগ্রামী চেতনার প্রতীক হয়ে আছে।
এই ২০২৩ সালে নজরুলের সেই গান নতুনরূপে হাজির করেছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। বাংলা গান নিয়ে তিনি আগেও কাজ করেছেন। ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: আ ফরগটেন হিরো’ সিনেমার জন্য রবীন্দ্রসংগীত ‘একলা চলো রে’-এর সংগীতায়োজন করেছিলেন তিনি। নজরুলসংগীত নিয়ে এবারই তাঁর প্রথম কাজ করা। সংগীত পরিচালক এ আর রহমান ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর মূল সুরের ছিটেফোঁটাও রাখেননি তাঁর সংস্করণে। একতারা আর বাঁশির সুরে গ্রামীণ বাংলার আবহ তৈরির চেষ্টা করেছেন তিনি। আর এতে লোকগীতির এক সুরেলা রোমান্টিক ঢং উঠে এসেছে। গানটি যে আদলে গাওয়া হয়েছে, তা সারি গানের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কাজী নজরুল ইসলামের এ গান। বাঙালির সামষ্টিক অবচেতনে এ গান বিপ্লবের সমার্থক। তবে মূল গানের বিধ্বংসী শক্তির ব্যাপারটি এ আর রহমানের নতুন সংস্করণের সুরে একেবারেই অনুপস্থিত। আর এতেই চটেছেন সবাই। শুধু সাধারণ শ্রোতারাই নয়, শিল্পী-সুরকার-চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষেরা এমনকি কাজী পরিবারের সদস্যরাও গোপন রাখেননি তাঁদের ক্ষোভ।
‘ভুলেছ সেই সে লড়াই?
কত মা কতশত ভাই এ সুর শুনে দেশের টানে
জীবন দিলো?
কার এমন সাহস হলো
এগানে এ সুর দিল?
রক্তে জ্বালা আগুন নিয়ে করল খেলা!’ (দীধিতি)
এ আর রহমানের সুরারোপিত ছবিতে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটা রয়েছে ৩৫-৩৬ সেকেন্ডের মতো। গানের দৃশ্যটা দেখে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলো, গানটার দৃশ্যে রয়েছে-১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়ে নাচগান করে রীতিমতো উৎসব করছে আর গাইছে। ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে।
চলচ্চিত্রে দৃশ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য বুঝে সেই দৃশ্যের উপযোগী গানের সুর সৃষ্টি করা সুরকারের কাজ। ঐ পরিবেশে বিপ্লবী গান কি খাটে? তাই অমন আনন্দঘন পরিবেশে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ লোকগীতির এক সুরেলা রোমান্টিক ঢঙে গাওয়া হয়েছে। সিনেমার স্ক্রিপ্টে যদি গান গেয়ে আনন্দ করার দৃশ্য থাকে এবং গানটা যদি হয় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, তাহলে ঐ দৃশ্য ও গানের কোনো প্রকার অসংগতির দায়ভার পড়বে স্ক্রিপ্টরাইটার ও পরিচালকের উপর, কোনো অর্থেই সম্পূর্ণভাবে সুরকারের উপর না।
এই বিতর্ক মাথায় রেখে ‘পিপ্পা’ ছবির অন্যতম প্রযোজক সিদ্ধার্থ রয় সামাজিক মাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘…গানটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে শ্রদ্ধা জানানোই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। গানের কথা ব্যবহার এবং সুরের পরিবর্তন চুক্তি অনুযায়ী করা হয়েছে।…আমরা মূল গানটিকে ঘিরে শ্রোতাদের আবেগকে সম্মান করি। শিল্প যেহেতু ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আমাদের পদক্ষেপ যদি কারো আবেগে আঘাত করে থাকে, তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’
যদিও এ আর রহমান এখন পর্যন্ত এই বিতর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তবে কর্তৃপক্ষ যেহেতু ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, সুতরাং এ আর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আর সুযোগ আছে কি?
প্রেক্ষাপট ও বিকৃতি
শাহীনুর রেজা
‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ উদ্দীপনামূলক এই গানটি বাঙালি কবি, বাংলাভাষার কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ও সুরারোপিত। ১৯২২ সালে ‘বাঙ্গলার কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় গানটির বাণী মুদ্রিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও সহকারী সম্পাদক হেমন্ত কুমার সরকার। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জনকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী পত্রিকা সম্পাদনার ভার নেন। তিনি এই সময়ে ‘বাঙ্গলার কথা’য় ছাপাবার জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে একটি কবিতা দিতে অনুরোধ করতে দাশ পরিবারের সুকুমার রঞ্জন দাশকে পাঠান। স্মৃতিকথায় মুজফ্ফর আহমদ জানিয়েছেন যে, সুকুমার রঞ্জন দাশ নজরুলের সঙ্গে কোথায় দেখা করেছিলেন তালতলা না কলেজ স্ট্রিটে সেটা আর তাঁর মনে নেই। তবে সেসময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। সুকুমার রঞ্জন আর তিনি বসে আস্তে আস্তে গল্প করছেন, আর কাছেই বসে নজরুল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কবিতা লিখে চলছেন। কবিতার শিরোনাম হলো ‘ভাঙার গান’। অনেকে মনে করেন ‘ভাঙার গান’ হুগলি জেলে লেখা হয়েছিল-এটা ঠিক নয়। তবে জেলখানায় গানটি গাওয়ার সময় বন্দীরা ভীষণ খেপে গিয়েছিল। কারণ ‘যত সব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা’ বলায় বন্দীরা ভেবেছিল তাদের ‘শালা’ বলে গালি দেওয়া হয়েছে। অবশ্য ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি।
‘ভাঙার গান’ শিরোনামের এ গানটি ২০ জানুয়ারি, ১৯২২ সালে ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গানটি পরবর্তী সময়ে গিরীন চক্রবর্তীর সংগীতায়োজন ও কণ্ঠে দুটি কোম্পানি থেকে রেকর্ড হয়। প্রথমটি জুন ১৯৪৯ সালে কলম্বিয়া থেকে, রেকর্ড নম্বর-জিই৭৫০৬ এবং দ্বিতীয়টি জানুয়ারি ১৯৫০ সালে এইচএমভি থেকে, রেকর্ড নম্বর-এন ৩১১৫২।
এইচএমভি-র রেকর্ডকৃত গানটি ১৯৫০ সালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ এবং ১৯৬৯-৭০ সালে কালজয়ী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। গানটি নজরুলের ‘ভাঙার গান’ কাব্যে অন্তর্ভুক্ত। দেখা যাচ্ছে, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি কবি লিখেছেন ১৯২১ সালের শেষে, পরের বছরের শুরুতেই ১৯২২ সালে তা পত্রিকায় ছাপা হয় কবিতা হিসেবে। এরপর কোনো একসময় নজরুল এতে সুর দেন এবং তাঁর জেলজীবনে (২৩.১১.১৯২২-১৫.১২.২০২৩) বিভিন্ন কয়েদির সঙ্গে কণ্ঠ দেন। কিন্তু এ সুরটির কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় না। ১৯৪২ সালে অসুস্থ হওয়ার পরে গানটি আরো আড়ালে চলে যায়। গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া গানটিই বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত। আর এই প্রতিষ্ঠিত সুরের বিকৃতিই সারা বিশ্বের নজরুল ভক্তদের কষ্ট দিয়েছে।
সম্প্রতি বলিউডের পরিচালক রাজা কৃষ্ণ মেননের ‘পিপ্পা’ সিনেমায় অস্কারজয়ী সুরকার ও সংগীত পরিচালক এ আর রহমান কাজী নজরুল ইসলামের জাগরণীমূলক ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির সুর বিকৃত করে উপস্থাপন করেছেন। মূল গানটি ছিল দ্রুত দাদরায় রিদমিক আর রহমানকৃত সুরটি বিয়ের গীতের মতো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আলোচিত ‘গরিবপুর যুদ্ধ’ নিয়ে ‘পিপ্পা’ সিনেমার গল্প। যশোরের কপোতাক্ষের তীরে সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরের অধিনায়কত্বে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ভারতীয় বাহিনীর ক্যাপ্টেন বি এম মেহতা উপ-অধিনায়ক ছিলেন। যুদ্ধটি হয়েছিল নভেম্বর ১৯৭১-এ। ঠিক এ কারণেই ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি পরিচালক বেছে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে সিনেমা, অথচ সে দেশের জাতীয় কবির উদ্দীপনামূলক গান থাকবে না-তা কি হয়!
অবাঙালি এ আর রহমান না-হয় নজরুলের গানের প্রতিষ্ঠিত সুরকে গুরুত্ব দেননি, কিন্তু যাঁরা গেয়েছেন-তীর্থ চট্টোপাধ্যায়-এর সঙ্গে রাহুল দত্ত, পীযূষ দাশ, শালিনী মুখোপাধ্যায়, দিলাশা চৌধুরী, শ্রয়ী পালসহ একাধিক বাঙালি শিল্পী এই দলে ছিলেন। তাঁদের কাছে সুরের এই বিচ্যুতি চোখে পড়ল না?
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এসংক্রান্ত খবর থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ ও তাঁর মা কল্যাণী কাজী ‘পিপ্পা’ সিনেমা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেন। চুক্তিনামায় প্রথম সাক্ষী ছিলেন অনির্বাণ কাজী। তবে এ ঘটনা কবি পরিবারের অন্য সদস্যবৃন্দ, বিশেষ করে বাংলাদেশে বসবাস করা সদস্যদের জানানো হয়নি।
কাজী অনির্বাণ স্বীকার করেন—মা গানটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন সুর এবং কথা না বদলে রিক্রিয়েট করার জন্য। কিন্তু সেই সময় ওদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গানটা ওরা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে চায়। মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা কিছুই শোনাননি।
এখন, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির সুর বিকৃতির জন্য আমরা কাকে দায়ী করব?

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *