একুশের চেতনার অতন্দ্র প্রহরী

একুশের চেতনার অতন্দ্র প্রহরী

এম আবদুল আলীম: পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যেসব তরুণ অমিত সাহস নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন, আহমদ রফিক তাঁদের অগ্রগণ্য। তখন তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, থাকতেন পলাশী ব্যারাকে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ভাষা আন্দোলনের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি থেকে নতুন করে লাভা উদগিরণ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথে নেমে আসে।

রাজনৈতিক নেতারাসহ বাংলা ভাষাপ্রেমী বিভিন্ন পেশার মানুষ তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন। আন্দোলন সুসংগঠিতভাবে পরিচালনার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে ২১ ফেব্রæয়ারি ধর্মঘট কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেই কর্মসূচি সফল করতে ছাত্ররা ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে।

আন্দোলন দমনে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে তা ভঙ্গের প্রশ্নে দেখা দেয় দ্বিধাদ্ব›দ্ব। অবশেষে ছাত্রদের দৃঢ়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশ থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ২১ ও ২২ ফেব্রæয়ারি মুসলিম লীগ সরকারের বর্বরোচিত হামলা ও নির্মমতায় শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, অহিউল্লাহ, আউয়ালসহ অনেকে।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সমাবেশ- সর্বত্রই আহমদ রফিকের ছিল প্রত্যক্ষ উপস্থিতি। পরবর্তীকালে একুশের চেতনা লালন ও বিস্তারে রাখেন সক্রিয় অবদান। আহমদ রফিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছেন সাহিত্য-সংস্কৃতি সাধনায়। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে একের পর এক রচনা করেছেন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চায়ও রেখেছেন অনন্য অবদান।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন এবং একুশের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে শাণিত করতে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদানের পাশাপাশি লেখনী সঞ্চালন করেছেন অবিরাম। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নকালেই আহমদ রফিক কবিতা-প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। যে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তারুণ্যের উদ্দীপনাভরা দিনগুলোতে বজ্রমুষ্টি তুলে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হয়েছিলেন, জীবনের বেশির ভাগ সময় সে ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেছেন। বাংলা ভাষার কীর্তিমান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের জীবন ও সাহিত্যের বিচিত্র দিক অনুসন্ধান করে বই লিখেছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্র গবেষণায় তিনি গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছেন। ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ’ (১৯৭৮), ‘পদ্মাপারের রবীন্দ্রগল্প’ (১৯৮৭), ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প’ (১৯৯৬), ‘রবীভুবনে পতিসর’ (১৯৯৮), ‘রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম : কৃষি ও কৃষক’ (২০০২), ‘প্রসঙ্গ বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ’ (২০০২), ‘রবীন্দ্রনাথ : এই বাঙলায়’ (২০১১), ‘রবীন্দ্রনাথ : দেশপ্রেম’ (২০১২); রবীন্দ্র গবেষণার এই বহুমাত্রিকতার জন্য তিনি ভূষিত হয়েছেন ‘রবীন্দ্রতত্ত¡াচার্য’ নামে।

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে জাতির সামনে তুলে ধরতে অলসভাবে কাজ করেছেন। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের সত্য জানাতে এবং তাদের হাতে একুশের চেতনার ঝাণ্ডা তুলে দিতে এই প্রয়াস চালিয়েছেন। নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য দলিলপত্রের সাহায্যে এই আন্দোলনের অনেক অজানা ঘটনা পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। শহীদ মিনার কিভাবে নির্মিত হয়েছিল, ভাষা শহীদের প্রকৃত সংখ্যা কত, এই আন্দোলনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষার্থী ও ঢাকাই জনতার ভূমিকা কী, কমিউনিস্ট পার্টি এবং তমদ্দুন মজলিস ভাষা আন্দোলনে কতটুকু অবদান রেখেছে-এসবের অনুপুঙ্খ বয়ান তাঁর মতো করে আর কেউ তুলে ধরতে পারেননি। ‘ভাষা আন্দোলন’, ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য’ (যৌথ), ‘ভাষা আন্দোলন ও উত্তরপ্রভাব’, ‘একুশের দিনলিপি’, ‘ভাষা আন্দোলনের ইতহাস-বিকৃতি : তমদ্দুন মজলিস ও কমিউনিস্ট পার্টি’-এসব গ্রন্থ তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসার ফসল।

আহমদ রফিক সব সময় বাংলা আর বাঙালির গৌরবকে মহিমান্বিত করেছেন। একুশ তাঁর চেতনায় যে দীপ্ত শিখা প্রজ্বলিত করেছিল, তা এখনো দীপ্যমান রয়েছে। তিনি চান ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমায় বাঙালিত্বের যে গৌরব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা অটুট থাকুক চিরকাল। নতুন প্রজন্ম ধারণ করুক একুশকে। বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুক সর্বদা। ৯৫তম জন্মদিনে একুশের চেতনার এই অতন্দ্র প্রহরীকে জানাই রাশি রাশি ভালোবাসা।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *